UA-199656512-1
top of page


ree



শ্রী রামচন্দ্র কি মাংসাহারী ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে রয়েছে বিশাল যুক্তিতর্ক। একদল বলছে রামজী মাংসাহারী ছিলেন না, আরেক দলের দাবী রামজী মাংস খেতেন। যদিও আদি সনতানী পরম্পরা যথাঃ- শঙ্কর, রামানুজী, মাধ্ব, নিম্বার্ক, বল্লভ, রামানন্দী, গৌড়ীয়াদি পরম্পরা এই ব্যাপারে একমত যে, রামচন্দ্র মাংসাহারী ছিলেন না। তারপরও অনেকেই নিজেকে পরম্পরার অংশ দাবী করে বা না করে পরম্পরা সিদ্ধ কথাটির বিরুদ্ধে নানান যুক্তি দাঁড় করায়, যেগুলো নেহাৎ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তাই বিষয়টার একটা মীমাংসা প্রয়োজন। এই মীমাংসার উদ্দেশ্য নিয়েই বিষয়টা নিয়ে পর্ব আকারে লিখা শুরু করলাম।


জয় শ্রী রাম।।


এই পর্বে আলোচনা করবো বাল্মিকী রামায়ণের থেকে রামের পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে যাওয়ার পূর্বে ও যাত্রাপথে বিভিন্ন জনের সাথে বার্তালাপের কিছু অংশ এবং মাতা সীতার সহিত লঙ্কায় সাক্ষাতের সময় হনুমানজীর কিছু কথা নিয়ে।


যখন শ্রী রামচন্দ্রের বন গমনের আজ্ঞা হলো তখন তিনি নিজ মাতা কৌসল্যার নিকট অনুমতি নেবার জন্য আসেন। সেই সময় শ্রীরামচন্দ্র বলেন-


#(1) স ষট্ চাষ্টৌবর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে । আসেবমানো বন্যানি ফলমূলৈশ্চ বর্তয়ন্ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.২০.৩১)
>>[আমি] চৌদ্দ বৎসর কাল নির্জন বনে[বিচরণ এবং] ফলমূল আহার করে অবস্থান করব ।

ree


তারপূর্বে ২৯ নং শ্লোকে এ শ্রী রামচন্দ্র মাতা কৌসল্যাকে বলছেন-


#(2) চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে। কন্দমূলফলৈর্জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.২০.২৯)
>> (আমি) মুনিদের মতো আমিষ আহার ত্যাগ করে কন্দমূল ও ফলাহার দ্বারা জীবনধারণপূর্বক চৌদ্দ বৎসর জনহীন অরণ্যে বাস করব।

ree

পিতা দশরথের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পিতা দশরথকে শ্রী রামচন্দ্র বলেন-

#(3) ফলানি মূলানি চ ভক্ষয়ন্ বনে গিরীংশ্চ পশ্যন্ সরিতঃ সরাংসি চ । বনং প্রবিশ্যৈব বিচিত্রপাদপং সুখী ভবিষয়ামি তবাস্তু নির্বৃতিঃ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.৩৪.৫৯)
>>বনে প্রবেশ করে ফলমূল ভক্ষণ করব ; বনের পর্বত , নদী ,সরোবর এবং বিচিত্র সব বৃক্ষ দেখে সুখে থাকব । আপনার মনে শান্তি বিরাজ করুক ।

ree

ভরদ্বাজ মুনিকে নিজের বনবাসের কারণ সম্পর্কে বলে শ্রীরামচন্দ্র বলেন -

#(4) পিত্রা নিযুক্তা ভগবন্ প্রবেক্ষ্যামস্ত পোবনম্ । ধর্মমেবাচরিষ্যামস্তত্র মূলফলাশনাঃ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.৫৪.১৬)
>>ভগবন্ ! পিতা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমরা তপোবনে প্রবেশ করব এবং সেখানে ফলমূলাহারী হয়ে ধর্মাচারণ করব ।

ree

শ্রীরামচন্দ্র জাবালির নাস্তিকমত খণ্ডনের সময় বলেন-

(#৫) বনবাসং বসন্নেব শুচির্নিয়তভোজনঃ । মূলপুষ্পফলৈঃ পূণ্যৈঃ পিতৃন্ দেবাংশ্চ তর্পয়ন ।। সন্তুষ্টপঞ্চবর্গোহহং লোকযাত্রাং প্রবাহয়ে । অকুহঃ শ্রদ্দধানঃ সন্ কার্যাকার্যবিচক্ষণঃ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.১০৯.২৬-২৭)
>>বনবাসে থেকে নিয়ত পবিত্র-মূল-পুষ্প আহার ও পিতৃদেবদের তৃপ্তি বিধান এবং পঞ্চেন্দ্রিয়ের তৃপ্তি বিধান করে লোকযাত্রা নির্বাহ করব এবং অকপট শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্যাকর্তব্য বিচক্ষণ হব ।

ree

উপরোক্ত শ্লোক গুলো হতে দেখা যাচ্ছে, শ্রী রামচন্দ্র মাতা কৌসল্যা ও পিতা দশরথকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বনে গিয়ে ফলমূল খাওয়ার ভরদ্বাজ মুনিকে বলছেন তার পিতৃসত্য পালনের কথা, তথা ১৪ বছর বনবাস ও বনে গিয়ে ফলমূল খাওয়ার কথা আবার জাবলীকেও বলছেন তিনি বনবাসে থেকে ফলাহার করবেন ও এই ব্যাপরে তিনি শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্য পরায়ণ হয়ে বিচক্ষণ ভাবে তার কর্তব্য পালন করবেন। কৌশল্যা মাতাকে তিনি বলেছেন বনবাসের সময় মুনিদের ন্যায় আমিষ আহার ত্যাগ করবেন।


অর্থাৎ বনে গিয়ে রামচন্দ্রের শুধু ফলমূল আহার করার কথা রামচন্দ্রের বচনে স্পষ্ট প্রকাশ পায়।

রামচন্দ্রের দুটি বিখ্যাত প্রতিজ্ঞা আছে। যথাঃ-

এক তো তিনি তাহার মাতা কৈকেয়ীর সম্মুখে প্রকট করেছিলেন -
#(6) " রাম দ্বির্নাভিভাষতে" (২|১৮।৩০) অর্থাৎ, রাম দ্বিচারী নয় বা দুইরকম কথা বলেন না।

ree

দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা তিনি সীতাজীর সম্মুখে এই রূপে রেখেছিলেন -

#(7) অপ্যহং জীবিতং জহ্যাং ত্বাং বা সীতে সলক্ষ্মণম্। ন তু প্রতিজ্ঞাং সংশৃত্য ব্রাহ্মণেভ্যো বিশেষতঃ।। (৩|১০।১৮ )
>> সীতে! আমি নিজের জীবন, এমনকি লক্ষ্মণসহ তোমাকেও ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু প্রতিজ্ঞা, বিশেষত ব্রাহ্মণদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অবহেলা করতে পারি না।

ree

অর্থাৎ শ্রীরাম কখনো দুইকথা বলেন না। তার প্রাণ গেলেও তিনি কখনো কথা ঘুরাবেন না। আর কাউকে কথা দিলে তা প্রাণের বিনিময়ে হলেও রাখবেন। সুতরাং শ্রীরামচন্দ্র যে পূর্বে মাতা ও পিতাকে কথা দিয়েছেন আমিষ আহার বর্জন করে ফলমূল আহার করবেন তার অনর্থ কখনো হতে দিবেন না। তার সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অবশ্যই রক্ষা করবেন। আবার মুনি ভরদ্বাজ ও নিষদরাজ গুহের কাছে যে তিনি তার বনে গিয়ে ফলমূল আহারের কথা বললেন, এই কথার অন্যথা কখনো করবেন না শ্রীরামচন্দ্র, কেননা তিনি দ্বিচারী নন।


আবার লঙ্কায় মাতা সীতার সাথে সাক্ষাৎ করার সময় হনুমানজী বললেন,

#(8) ন মাংসং রাঘবো ভুঙ্ক্তে ন চৈব মধু সেবতে। বন্যং সুবিহিতং নিত্যং ভক্তমশ্নাতি পঞ্চমম্।। (সুন্দরকান্ড -৩৬/৪১)
>> রাঘববংশের কেউ মাংস ভক্ষণ করেন না, মধু পানও করেন না। শ্রী রামচন্দ্র নিত্য চারপ্রহর উপবাসে থেকে পঞ্চম প্রহরে শাস্ত্র বিহিত বন্য ফল-মূল ও নীবার অন্নাদী ভোজন করেন।

ree

এখানে হনুমানের কথায়ও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে রামচন্দ্র মাংসাহারী নন।


উপরোক্ত শ্লোক গুলোয় পূর্বপক্ষের(পূ.প.) শঙ্কা উত্তরপক্ষদ্বারা(উ.প.) নিরসনঃ-


পূ.প.- উক্ত ২.২০.৩১, ২.৩৪.৫৯, ২.৫৪.১৬, ২.১০৯.২৬-২৭ এ তো রামচন্দ্র বলছেন বনে গিয়ে ফলমূল আহার করবেন, এটা তো বলেন নি যে, তিনি মাংসাহার করবেন না। তাহলে তো বনে গিয়ে মাংস খেলে কোনো সমস্যাও নাই।


উ.প.- ধরুন কেও একজন বলল, 'আমি শাকাহারী'। এখন এর অর্থ যদি যদি আপনি ধরে নেন যে, " সে বলেছে সে শাকাহারী, সে তো বলে নাই যে সে মাংস খায় না। সুতরাং সে মাংস খেতেই পারে।" তাহলে সেটা আপনারই বোকামী হবে। কেউ যদি আজ নিজেকে শাকাহারী দাবী করে কাল মাংসাহার করে তাহলে সে ভন্ড ও দ্বিচারী। আর প্রভু শ্রীরামচন্দ্র কখনোই এমন দ্বিচারী ছিলেন না, তা তার কথায় (২.১৮.৩০) এ স্পষ্ট বলা আছে। তারপর ২.২০.২৯ এ তো তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, "মুনিদের মত আমিষ আহার ত্যাগ করে ফলমূল আহার করবো"। অর্থাৎ রামচন্দ্র বনে গিয়ে শুধু ফলমূল আহারের কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন, অন্যকিছু আহারের ইঙ্গিত করেন নি।


পূ.প.- তাহলে যেহেতু, ২.২০.২৯ এ মুনিদের মত ত্যাগ করবেন বলেছেন, সেহেতু কিছু কিছু মুনি তো মাঝে মাঝে আমিষ আহার করতেন। তাহলে তো রামচন্দ্রও ঐ মুনিদের মত আমিষ আহার করতেও পারেন, তাতে সমস্যা কোথায়? তিনি তো মুনিদের মত ত্যাগ বলেছেন।


উ.প.- বেশ। যেসকল মুনি আমিষ আাহার করেন তারা আমিষ আহার ত্যাগী হলেন কিভাবে? রামচন্দ্র মুনিদের মতো ত্যাগ বলেছেন, অর্থাৎ যেসকল মুনিরা আমিষ আহার করেন না বা আমিষ আহার ত্যাগ করেছেন, তাদের বুঝিয়েছেন। নয়তো যেসব মুনিরা মাংস খায় তাদের মত করে বললে রামচন্দ্র বলতেন যে, " মুনিদের মত মাংসাহার করবো"। সংস্কৃত "হিত্বা" অর্থাৎ ত্যাগ শব্দটা উল্লেখ করতেন না। কারণ ত্যাগ মানে কখনোই মাঝে মাঝে ভোগ নয়। মাঝে মাঝে ভোগ করে ত্যাগ শব্দ ব্যবহারকে ভন্ডামি বলে৷ যেমন- এখন কেউ যদি বলে, " আমি সন্ন্যাসী, গৃহত্যাগী। তবে মাসে একবার গৃহে যাই ভোগ করি। আমার স্ত্রী আছে, স্ত্রী ভোগ করি। কিন্তু আমি সন্ন্যাসী গৃহত্যাগী। মাঝে মাঝে ভোগ করি আরকি।" তাহলে তাকে সন্ন্যাসী নয় ভন্ড বলতে হবে। আর বেশিরভাগ মুনিগণই আমিষ আহার ত্যাগীই ছিলেন। তারা আমিষ আহারের বিরুদ্ধে বলতেন। যেমন- মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১০০ তম অধ্যায়ে নারদ, ভীষ্ম, দেবগুরু বৃহস্পতি, মার্কন্ডেয় ঋষির মত বড় বড় মুনি ও মহাত্মাগণের মতামত দেখে নেই-

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন-

#(9a) তপস্বী বিচক্ষণেরা মাংসাহার করেন না(২১)

ree

#(9b) নরাদমুণির মতে যে পরমাংস দ্বারা নিজের বৃদ্ধি সাধন করতে চায় সে অবসন্ন হয়।(৪৩)
#(9b) দেবগুরু বৃহস্পতির মতে, সাধুরা মাংসাহার রহিত হইয়াই যজ্ঞ, দান, তপস্যা করে থাকেন।(৪৪)


ree

#(9c) জ্ঞানীরা মাংসাহার ত্যাগের প্রশংসা করেন।(৫০)

ree

#(9d) সংযতচিত্ত মহর্ষিগণ বলেন যে, মাংস ভক্ষণ না করায় আয়ু, যশ, স্বর্গ ও বিশেষ মঙ্গল হয়।(৬৬)
#(9d) মার্কন্ডেয় ঋষির মতে, মাংসাহারীগণ পাপী(৬৭-৬৮)

ree

উপরোক্ত মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১০০ তম অধ্যায়ে ভীষ্ম, বৃহস্পতি, মার্কন্ডেয়, নারদের মত মুনি মহাত্মাদের বচনে মাংসাহারের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। ২১, ৪৪,৫০,৬৬ শ্লোকে দেখা যাচ্ছে, তপস্বী, সাধু, জ্ঞানী, সংযতচিত্ত মহর্ষিগণ মাংস ভক্ষণ করেন না।

আবার রামায়ণে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে যখন শ্রীরামচন্দ্র গিয়েছিলেন তখন ভরদ্বাজ মুনির সাথে রামচন্দ্র ফলমূল ভোজন করেছিলেন-

#(10) নানাবিধানন্নারসান্ বন্যমূলফলাশ্রয়ান্। তেভ্যো দদৌ তপ্ততপা বাসং চৈবাভ্যকল্পয়ৎ।। (বাল্মিকী রামায়ণ- ২/৫৪/১৮)
>> তখন উগ্র তপসয়ার তাপে উত্তপ্ত সাংসারিক বন্ধন যাঁর (সেই ঋষি ভরদ্বাজ) তাঁদের( রাম, লক্ষ্মণ, সীতা) জন্য বনজাত নানাবিধ ফলমূল ও পানীয় আহরণ করলেন এবং উপযুক্ত বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করলেন।

ree

আবার যখন মহর্ষি বিশ্বামিত্র, মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে পাদচারণ করেন তখন মহর্ষি বশিষ্ঠ মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে ফলমূলাদি দিয়ে আপ্যায়ন করেন-

#(11) উপবিষ্টায় চ তদা বিশ্বামিত্রায় ধীমতে। যথান্যায়ং মুনিবরঃ ফলমূলমুপাহরৎ।। (বাল্মিকী রামায়ণ-১/৫২/৩)
>> তখন প্রদত্ত আসনে উপবিষ্ট প্রজ্ঞাবান বিশ্বামিত্রকে মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠদেব শাস্ত্রবিধি অনুসারে ফলমূলাদি উপহার দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।

ree

সুতরাং মুনিরা সাধারণত মাংসাহার করেন না এটা স্পষ্ট।

এবার কোনে মুনি যদি কোনে বিশেষ কারণে মাংস খেয়েও নেন তথাপি সেই ব্যাতিক্রম ঘটনা কখনো সাধারণ উদাহরণ হিসেবে টানা অনুচিত। কারণ ব্যাতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না।


পূ.প.- আচ্ছা বেশ! এখানে রামজী বলেছেন, মুনিদের মতো আমিষ আহার তয়াগ করবেন, এর মানে কি? রামচন্দ্র কি পূর্বে আমিষ আহার করতেন যে এখন ত্যাগ করবেন?


উ.প.- প্রথমত বনবাসের পূর্বে রামজীর আমিষ আহার তথা মাংসাহার করেন নাই। বাল্মিকী রামায়ণে তার বিবরণ নই। দ্বিতীয়ত ত্যাগের অর্থ সবসময়, পূর্বে ভোগ করতো, এখন ছেড়ে দিয়েছে অর্থাৎ ছেড়ে দেওয়া আর্থে বয়বহৃত হয় না। আর এখানে মূল সংস্কৃত শব্দ 'হিত্বা' এর বাংলা অর্থ হয়েছে ত্যাগ। #(12) ত্যাগ শব্দ বর্জন, পরিহার, ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে ত্যাগ শব্দটি পরিহার করা অর্থে বয়বহৃত হয়েছে।


ree

যেমন- এক সুবোধ বালক বাড়ি ছেড়ে দূরে কোনো এলাকায় পড়াশোনা করতে যাবে। পূর্বে সে কখনো ধূমপান ও খারাপ সঙ্গ করে নি। বালকটি চলে যাওয়ার আগে তার মা কে বলল, " মা, তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করব এবং খারাপ সঙ্গ, খারাপ কাজ ও ধূমপান পরিহার করে চলব। " এর মানে তো আর এই না যে সে পূর্বে ঐ খারাপ সঙ্গ, ধূমপান এসব করতো, বাইরে গিয়ে ছেড়ে দিবে। এখানে ছেড়ে দেওয়া অর্থ গৃহীত হয় নাই। পরিহার অর্থ গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ ছেলেটি পূর্বে তো ঐসব অকাজ করতোই না বরং দূরে গেলেও যে ঐসব করবে না, সে বিষয়ে তার মাকে আস্বস্ত করছে অর্থাৎ যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশেই ছেলেটি ঐসব বাজে কাজ হতে দূরে থাকবে। শ্রীরামচন্দ্রও ঠিক এভাবে পরিহার অর্থে ও তার মাতাকে আস্বস্ত করা অর্থে হিত্বা বা ত্যাগ শব্দটি বয়বহৃত হয়েছে। আবার শ্রীমদ্ভাগবতের ৩য় স্কন্দের ১২ তম অধ্যায়ে পাওয়া যায়-

#(13)প্রথমে ব্রহ্মা সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামক চারজন মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন ঊর্ধ্বরেতা এবং তাই তাঁরা জড়জাগতিক কার্যকলাপে লিপ্ত অনিচ্ছুক ছিলেন। ৪ #(14) ব্রহ্মা তাঁর পুত্রদের সৃষ্টি করে বললেন, "হে পুত্রগণ! এখন তোমরা প্রজা সৃষ্টি কর।" কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেবের ভক্তিপরায়ণ হওয়ার ফলে, মোক্ষধর্মনিষ্ঠ কুমারেরা সেই কার্যে তাঁদের অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। ৫ (শ্রীমদ্ভাগবত-৩/১২/৪-৫)


ree

ree

এখন যদি বলা হয় চতুস্কুমারগণ সংসারধর্ম ত্যাগী ছিলেন। এখনে ত্যাগ বলা মানে পূর্বে তারা সংসার ধর্ম করতো এমন নয় কখনোই। তারা আদি কাল হতেই সংসারধর্ম ত্যাগী। এখানে ত্যাগ শব্দটি পরিহার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ তারা সংসার ধর্ম পরিহার করেছেন। এক্ষেত্রে তাদের ত্যাগটা পরিহার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, পূর্বে কখনো গ্রহন করতেন এই অর্থে নয়। সেরূপ ভগবান রামচন্দ্রের ক্ষেত্রেও। রামচন্দ্রের বনে যাওয়ার পূর্বের কাহিনীতে মাংসাহারের কোনরূপ কথাই পাওয়া যায় না। তাই এখানে হিত্বা বা ত্যাগ শব্দ সর্ব অবস্থায় পরিহার ও মাতাকে এই ব্যাপারে আস্বস্ত করার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে।


পূ.প.- শ্রীরামচন্দ্র দ্বিচারী নয়, বুঝলাম। কিন্তু রামচন্দ্র তো তার মাতাকে ২.২০.২৯২.২০.৩১ এ নির্জন ও জনহীন অরণ্যে বাস করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বনবাস কালে তো অধিকাংশ সময়ই ঋষিদের সঙ্গে থেকেছেন বা ঋষি আশ্রমের আশে পাশে থেকেছেন। তাহলে তা নির্জন হলো কিভাবে? এক্ষেত্রে রাম কি দ্বিচারী হলেন না?


উ.প.- এখানে আপনার বুঝতে কিছুটা ভুল হচ্ছে। নির্জনে বা জনশূন্য বলতে লোকালয়ে তথা গ্রামে বা উন্নত এলাকায় বসবাসকারী মানুষহীন বুঝানো হচ্ছে। কারণ পূর্বে অরণ্যসমূহে মুনি ঋষিদের আশ্রম থাকতো তারা সেখানে ধ্যান, সাধনা, তপস্যা করতেন। তারা সাধারণ লোকেদের থেকে আলাদা ছিলেন। তারা ভোগ, কাম্যকর্ম, মোহ এসব থেকে দূরে থাকতেন। তারা সময় অতিবাহিত করতেন তপস্যায়। মুনিরা তাদের আশ্রমে থেকে তপসয়া করতেন সেই আশ্রম গুলো "নির্জন অরণ্যে অবস্থিত" এরূপই বলা হতো। আশ্রমে একাধিক মুনিঋষিগণ থকতেন ও তপস্যা তপস্যা করতেন। তারা একত্রিত হয়েও তপস্যা কর্য করতেন। এবার মুনি ঋষিরা তো একত্রিত হয়েও তপস্যা বা ধ্যান করলেও তারা নির্জনে ধ্যান করেন বলা হত, অথচ তাদের সাথে বা আশে পাশে একাধিক জন থাকতো। এখানে নির্জন বা জনশূন্য বলতে মুনিশূন্য নয় বরং লোকালয়ে বসবাসকারী মানবশূন্য বোঝানো হয়। আর এজন্য রামচন্দ্র জনশূন্য, নির্জন বন বলার পাশাপাশি ভরদ্বাজ মুনিকে বলার সময় ২.৫৪.১৬ এ তপোবন শব্দটিও উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রামচন্দ্র বিজনে, নির্জন, জনশূন্য বন বলতে তপোবনই তথা তপস্বীরা যেখানে অবস্থান করছেন সেই বন বুঝিয়েছেন।


পূ.প.- সুন্দর কান্ডে-৩৬/৪১ শ্লোকে "রাঘবো" শব্দ দিয়ে কি রঘুবংশ বুঝানো হচ্ছে? নাকি শ্রীরামচন্দ্রকে বুঝানো হচ্ছে?


উ.প.- প্রদত্ত গীতপ্রেসের রামায়ণের অনুবাদে রাঘবো শব্দের অর্থ রঘুবংশ করা হয়েছে। আবার অন্যান্য কিছু অনুবাদে রাঘবো অর্থ করা হয়েছে শ্রীরামচন্দ্রকে। ব্যকরণগত দিক থেকে দুটিই হয়। কেননা, #(15) ২.৮৬.৩-৪ নং শ্লোকে লক্ষণকে রাঘবনন্দন বলা হয়েছে, অর্থাৎ রঘুকুলের নন্দন সেই হিসেবে রাঘবো শব্দের অর্থ রঘুবংশ হয়।


ree

আবার রামায়ণের বিভিন্ন শ্লোকে রামচন্দ্রকে রাঘব বলা হয়েছে সেই হিসেবে রঘুকুলপতি অর্থ রাঘব হতে পারে। দুইটিই গ্রহন করা যেতে পারে।


পূ.প.- যদি এখানে রাঘব শব্দে রাম ধরে নেই তবে তো, "রামচন্দ্র মাংস খান না" এমন অর্থ দাঁড়ায়। আবার রাঘব অর্থ রঘুবংশ ধরে নিলে, "রঘুবংশের কেউ মাংস খান না" এমন দাঁড়ায়। তাই তো?


উ.প.- হ্যাঁ।


পূ.প.- এবার দেখুন। উক্ত শ্লোকটি সীতা মাতার সাথে লঙ্কায় হনুমানের কথোপকথন। হনুমান বলছেন রামচন্দ্র কতোটা দুঃখে আছেন, সীতা মাতাকে ছাড়া। দুঃখ হেতু তিনি মাংস খাচ্ছেন না। কেননা পরবর্তী শ্লোকেই বলা আছে তার শরীরে কীটপতঙ্গ সরীসৃপ এসে পড়লেও তিনি তা সরান না। এরমানে কি রামচন্দ্র কখনোই শরীরে কীটপতঙ্গ বসলে সরাতেন না? মোটেই তা নয়, সীতামাতার বিরহে প্রভু শ্রীরাম এতোটাই দুঃখিত ছিলেন যে তিনি মাতা সীতার চিন্তায় উদাসীন থাকতেন। তাই এমন হতো। তাই বলা যায় যে শ্রীরামচন্দ্রের মাংসাহার না করাটা দুঃখবশত। সব সময়ের জন্য না।


উ.প.- আপনার ধারণা ভুল। উক্ত শ্লোকে হনুমান স্পষ্টই বলেছেন রামচন্দ্র মাংসাহার করেন না। এটা দিয়ে বুঝানো হচ্ছে যে সীতামাতার বিয়োগে তিনি দুঃখিত হওয়া সত্যেও কখনো তিনি তাঁর নিজ প্রতিশ্রুতি থেকে বিন্দুমাত্রও সরে আসেন নি। এর পরবর্তী শ্লোকে রামচন্দ্র দুঃখের বশবর্তী হয়ে উদাসীনতা বশত কি কি করতেন তা বলা হয়েছে। রামচন্দ্র বনে আসার পূর্বে কথা দিয়েছিলেন বনে গিয়ে তিনি মাংসাহার করবেন না, ফলমূলই আহার করবেন। আবার হনুমানও এদিকে বলছেন রামচন্দ্র মাংসাহার করেন না। তাহলে এবার এই কথাগুলোর ফলাফল দাঁড়াচ্ছে বনবাসে থাকা অবস্থায় তিনি মাংসাহার করেন নি। আর বনবাসের পূর্বে ও পরে মাংস খাওয়ার কোনো দৃষ্টান্তও নাই। সুতরাং ফলাফল হিসেবে কিন্তু রামচন্দ্র মাংসাহার করেন নি এটাই আসছে।


পূ.প.- আচ্ছা সব বুঝলাম। কিন্তু উক্ত শ্লোকে, মধু কি দোষ করলো? মধুপান কেন করছেন না? মধুপানে তো সমস্যা নাই। তারমানে এই বোঝা যাচ্ছে মাংস ও মধু উভয়ই তিনি দুঃখের তাড়নায় ছেড়ে দিয়েছেন।


উ.প.- এখানে গীতাপ্রেসের অনুবাদটায় মধু অর্থ মধুই রাখা হয়েছে। বাংলা অনুবাদে সরাসরি সংস্কৃত শব্দটাই গ্রহন করা হয়েছে অর্থাৎ তৎসম শব্দ গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত মধু শব্দের বহু অর্থই হতে পারে।মৌচাকের মধুও হতে পারে আাবার মদ্যও হতে পারে। এখানে মধুর মদ্য অর্থ গৃহীত হয়েছে। নিচে #(16) ইংরেজী রামায়ণ হতে, #(18) মহাভারতের ভারত কৌমুদী হতে দেখানো হচ্ছে যে মধু মদ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়।


ree

ree

এখন দেখুন কেউ দুঃখ পেলে তো মদ্য, মাংস আরো বেশি করে খাওয়ার কথা, কিন্তু এখানে হনুমান স্পষ্ট করে বলছেন রামচন্দ্র দুঃখে আছেন তথাপি তিনি তার কর্তব্য থেকে দূরে সরে মাংস, মদ্য গ্রহন করেন নি। কেননা তিনি মাংস গ্রহন করলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন, যেটা মর্যাদাপুরুষোত্তম রাম কখোনো করেন না। কেননা পূর্বে দেখানো হয়েছে রাম দ্বিভাষী নন। তাই এখানে এটাই প্রকাশ পায় যে রামচন্দ্র তাঁর কর্তব্য কর্মে অটল আছেন।


এরপর বনমধ্যে বাস করা কালীন সময়ের কাহিনীতে রামায়ণের বিভিন্ন শ্লোক দেখে আপাত দৃষ্টিতে রামচন্দ্রের মাংসাহারের আশঙ্কা জাগে। সেসব শঙ্কারও পরবর্তী পর্ব গুলোতে মীমাংসা করা হবে।


জয় জয় শ্রী শ্রী মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্র জী কী! জয়!


জয় শ্রী রাম


---- শ্রী প্রান্ত সাহা

 
 
 

সম্প্রতি অনিতা দেবশর্মা তর্করত্ন নামক এক মহিলা সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে যাচ্ছেতাই রকমের জঘন্য অপপ্রচার চালিয়েছেন। তার সেসকল অপপ্রচার এই আর্টিকেলে খন্ডন করা হল।


ree

প্রথমেই তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কে হত্যা করা হয়েছে বলে মহাপ্রভুর ভগবত্বা খন্ডন করতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন “শুনতে পাওয়া যায়, চৈতন্যদেব জগন্নাথদেবের মুর্তিতে লীন হয়ে গেছিলেন। কিন্তু চৈতন্যদেবের পরিধেয় কাপড় ঐ জগন্নাথ দেবের শরীরে বেঁঝে ছিল। এখানে শঙ্কা হতে পারে যে, রাক্ষস জগন্নাথদেব এত লম্বা শরীর বিশিষ্ট চৈতন্যদেবকে গিলে খেলেন অথচ তাঁর পরিধেয় কাপড়কে খেলেন না। বলা বাহুল্য, ভগবানে লীন হয় মন প্রাণ ; শরীর কখনও ভগবানে লীন হয় না। শরীর যদি ভগবানে লীন হতো, তবে সাধু মহাপুরুষদের দেহ পৃথিবীতে দাহ করতে হতো না। চৈতন্যদেবকে পুরীতে হত্যা করা হয়েছিল ; এবং শরীর নিখোঁজ করার অভিপ্রায়ে প্রচার করা হলো চৈতন্যদেব, জগন্নাথের মুর্তিতে লীন হয়েছেন।”


➤ মহাপ্রভুকে হত্যা করা হয়েছিল এরূপ কোন প্রকৃষ্ট প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। এখন আপনাদের অনুমান সত্য হলেও মহাপ্রভুকে হত্যা করা হয়নি।


মহাভারতে দেখা যায় জরা নামক ব্যাধ শ্রীকৃষ্ণকে তীরবিধ্ব করে এবং তখন ভগবান অন্তর্হিত হন এবং লিঙ্গপুরাণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষ দাহ করার ঘটনাও পরিলক্ষিত হয়। তাহলে আপনি কী একে হত্যা বলবেন। ভগবানকে কী হত্যা করা যায়? কখনোই না। অলৌকিক ঘটনার প্রতি শ্রদ্ধাবিহীন লোক প্রশ্ন তুলবে এটিই স্বাভাবিক। এজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এরূপ লীলা করে অন্তর্হিত হয়েছিলেন।


ঠিক তেমনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হলেন স্বয়ং ভগবান। কাজেই তাকে কেউ খুন করতে পারে না। পুরীতে তাকে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটলেও তাকে জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কোন সুযোগ নেই। কারণ ভগবান গীতায় বলেছেন,


জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।

ত্যাক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোঽর্জুন।।


পদার্থ

জন্ম- জন্ম

কর্ম- কর্ম

চ- এবং

মে- আমার

দিব্যম্- দিব্য

এবম্- এভাবে

যঃ - যিনি

বেত্তি- জানেন

তত্ত্বতঃ - যথার্থভাবে

ত্যক্ত্বা- ত্যাগ করে

দেহম্- বর্তমান দেহ

পুনঃ - পুনরায়

জন্ম- জন্ম

ন- না

এতি- প্রাপ্ত হন

মাম- আমাকে

এতি- প্রাপ্ত হন

সঃ - তিনি

অর্জুন- হে অর্জুন!


ভাবার্থ

হে অর্জুন! যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন, তাহাকে আর দেহত্যাগ করিবার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয় না, তিনি আমার নিত্যধাম লাভ করিয়া থাকেন। (শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৪.৯)


কাজেই মহাপ্রভু যেহেতু স্বয়ং ভগবান সেহেতু তিনি কখনো খুন হইতে পারেন না। তিনি কেবল এরূপ ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে অন্তর্হিত হয়েছিলেন। মহাপ্রভু যে স্বয়ং ভগবান তার বহুবিধ শাস্ত্রপ্রমাণ রয়েছে। নিচে দুটি লিংক দেয়া হল।




এরপর তিনি লিখেছেন, “চৈতন্যদেব শৈব মতাবলম্বী ছিলেন এবং তিনি অদ্বৈতবাদীও ছিলেন।” ➤ ইহা সর্বৈব একটা বানোয়াট স্বকপোলকল্পিত মনোপ্রসূত বাক্য লেখকের। যদিও ইহা সর্বশাস্ত্র ও সর্বজনবিদিত ভগবান শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং কৃষ্ণ। তিনি একদিকে যেমন আরাধ্য পরতত্ত্ব আবার অন্যদিকে কৃষ্ণোপাসনার লোকশিক্ষকও বটে। সর্বত্র তিনি কৃষ্ণভজনশিক্ষাকেই তাঁর পার্ষদবর্গের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। "কাঁহা মোর প্রাণনাথ মুরলীবদন.." আদি বাক্যে তাঁর প্রাণনাথ ইষ্টদেব যে একমাত্র মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণই ; সেটা একজন শিশুরও অবোধ্য নয় !! 😂 কিন্তু সেটা লেখকের এখনো বোধগম্য হয় নাই। যদি বলেন, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু শঙ্করাচার্য্যের সম্প্রদায়ে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস দীক্ষা নেওয়ায় শঙ্করাচার্য্য অনুসারী ও অদ্বৈতবাদী ছিলেন, তাহলে এই যুক্তি খুবই অদ্ভুত, ভ্রান্তপূর্ণ ও হাস্যকর !! ★ মধ্বাচার্য্য অদ্বৈতবাদী অচ্যুতপ্রেক্ষ এর কাছে সন্ন্যাস নেন কিন্তু তিনি অদ্বৈতবাদ খণ্ডন করে শুদ্ধ দ্বৈতবাদই প্রচার করেন। ★ স্বয়ং শঙ্করাচার্য্যের পরম্পরাই দেখা যায়, সদাশিব—>বশিষ্ট ঋষি—>শক্তিমুনি —> পরাশর ঋষি—>#বেদব্যাস —>শুকদেব —>গৌড়পাদাচার্য্য —> গোবিন্দ ভগবৎপাদাচার্য্য —>#শঙ্করাচার্য্য দেখা যায় শঙ্করাচার্যের পরম্পরায় ব্যাসদেবকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক এই যে শঙ্করাচার্য্য স্বয়ই ব্যাসসিদ্ধান্তকে মান্য করেন নি। জগৎ সৃষ্টির বিষয়ে ব্যাসদেব বলেছেন “আত্মকৃতে পরিণামাৎ" ব্রহ্মসূত্র (১.৪.২৬) যার অর্থ হয় ব্রহ্ম জগৎ রূপে পরিণত হয়। কিন্তু শঙ্কর বলেছেন জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত। ব্যাসের পরিণামবাদ ভুল বলে তিনি বিবর্তবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিষয়টিই লোকশিক্ষক শ্রীমন্মহাপ্রভু অদ্বৈতবাদী সার্বভৌম ভট্টাচার্যের নিকট তুলে ধরেন, "পরিণামবাদ ব্যাস সূত্রের সম্মত। অচিন্ত্যশক্তি ঈশ্বর জগদ্রূপে পরিণত।। ব্যাস ভ্রান্ত বলি সেই সূত্রে দোষ দিয়া। "বিবর্তবাদ" স্থাপিয়াছে কল্পনা করিয়া।। (চৈ.চ, মধ্য, ৬/১৭০, ১৭২) "শঙ্কর দিগ্বিজয়" ৭ম পরিচ্ছেদ এ ও একটি কাহিনী আছে যে “শঙ্করাচার্য্য তার শিষ্যদের কাছে ব্রহ্মসূত্র ব্যাখ্যা করছিলেন তখন ব্যাসদেব এক ব্রাহ্মণের বেশে তাঁর সাথে ব্রহ্মসূত্র এর ওপর শাস্ত্রার্থ করেন। তার সাথে শঙ্করের বহু তর্ক, বাগ-বিতন্ডা হয়। শেষে ব্যাসের মত খন্ডণ করে আচার্য্য অদ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন ব্যাসদেব নিজ স্বরূপে এসে তাকে আশীর্বাদ করেন। " ব্যাসদেবের পরম্পরায় দীক্ষিত হয়েও শঙ্করাচার্য্য ব্যাসের মতের বিরোধী ছিলেন। সর্বসিদ্ধান্তসার সংগ্রহ গ্রন্থেও তিনি বৌদ্ধ, জৈন, পাশুপত, মীমাংসক, সাংখ্য, ইত্যাদি মতের সাথে বেদব্যাসের মতের ও খণ্ডন করেছেন। তেমনই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও কাশীতে অদ্বৈতবাদী প্রকাশানন্দ সরস্বতীকে ও পুরীতে সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের কাছে অদ্বৈতবাদ খণ্ডন করেন। লেখক নিজ সুবিধা হাসিল করতে চৈতন্যচরিতামৃত শাস্ত্র কে ব্যবহার করেছেন কিন্তু তিনি যে আদৌও তা সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করেন নি, বা করলেও মহাপ্রভুর অদ্বৈতবাদ খণ্ডন কে বরাবরই এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন, তা একজন বিদ্বান শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত পাঠকের কাছে অবোধ্য নয়। তাই দেখা যাচ্ছে শঙ্করাচার্য্যের দশনামী সম্প্রদায় এ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন বলেই চৈতন্য মহাপ্রভু কে অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী, শঙ্করের মতের অনুসারী বলা ভুল। এরূপ মন্তব্যকারী নিশ্চয়ই আনন্দ গিরি রচিত শঙ্কর দিগ্বিজয় কে অস্বীকার করবেন না। [বি.দ্র: এখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে অদ্বৈতবাদী নন, বরং তিনিও অদ্বৈতবাদ খণ্ডন করেছেন, সেটা বোঝাতেই শঙ্করাচার্যের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে, এতে যদি পাঠক সমাজ ভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ শঙ্করাচার্য্য বিদ্বেষী ; তাহা হবে সর্বৈব ভুল] তিনি আরও লিখেছেন, “তাঁকে হরিনাম প্রচার করতে বলা হয় ; কিন্তু তিনি দেখলেন যে, হরিনামের মধ্যে ওঙ্কার উপস্থিত নেই। তাই জন্য তিনি হরিনাম প্রচার করেন নি। হরিনাম প্রচার না করার অপরাধে চৈতন্যদেবকে হত্যা করা হয়।” ➤ আহা ! আষাঢ়ে গপ্পোর একশেষ। তিনি সর্বদাই হরিনামই প্রচার করেছেন। যার দৃষ্টান্ত চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত আদি শাস্ত্রে এমনকি মহাপ্রভু সমসাময়িক গ্রন্থেও তা বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর অবতীর্ণের কয়েকটি উদ্দেশ্যের মধ্যে গোলোকের প্রেমধন শ্রীহরিনাম সংকীর্তন জগতে প্রচারও একটি উদ্দেশ্য। কলিযুগের যুগধর্ম হরিনাম সংকীর্তনকেই বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুন শুন নিত্যানন্দ শুন হরিদাস। সর্বত্র আমার আজ্ঞা করহ প্রকাশ।। প্রতি ঘরে ঘরে গিয়া কর এই ভিক্ষা। বল কৃষ্ণ,ভজ কৃষ্ণ, কর কৃষ্ণ শিক্ষা।। ... হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরেরাম হরেরাম রাম রাম হরে হরে।। প্রভু কহে কহিলাম এই মহামন্ত্র। ইহা জপ গিয়া করিয়ে নির্বন্ধ।।... ( চৈতন্যচরিতামৃত) আদি পঁয়ার থেকে দেখা যায় তিনি সর্বত্রই হরিনামই প্রচার করেছেন। লেখিকা অবশ্য চৈতন্য চরিতামৃত মহাপ্রভুর মৃত্যুর ১৫০ বছর পরে রচিত এই কথা বলে চৈতন্য চরিতামৃত-কে অপ্রামাণিক প্রমাণ করার অপচেষ্টাও চালিয়েছেন। কাজেই তার জন্য আরও একটি প্রমাণ প্রদান করছি। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর সমসাময়িক বিশিষ্ট নৈয়ায়িক সার্বভৌম ভট্টাচার্যের সাথে পুরীতে তার শাস্ত্রালোচনা হয়েছিল। অতঃপর সার্বভৌম ভট্টাচার্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নিকট নিজেকে সমর্পন করেছিলেন। তিনি মহাপ্রভুকে উদ্দিষ্ট করে ১০০ টি শ্লোক রচনা করেন, যা শ্রীচৈতন্য শতকম্ নামে পরিচিত। এই শ্রীচৈতন্য শতকমে বলা হয়েছে, বিষণ্ণ চিত্তান্ কলিপাপ ভীতান্ সংবীক্ষ্য গৌরো হরিনাম মন্ত্রং। স্বয়ং দদৌ ভক্তজনান সমাদিশেৎ কুরুষ্ব সংকীর্ত্তননৃত্য বাদ্যান্।। শ্রীশ্রীশচীনন্দন গৌরহরি কলিহত জীবদিগকে বিষণ্ণচিত্ত এবং পাপে কলুষিত ও ভীত দেখিয়া স্বয়ং হরিনাম মহামন্ত্র প্রদান করিয়াছেন এবং তাঁহার ভক্তগণকে নৃত্যবাদ্য সহিত হরিনাম কীর্ত্তন করিতে অভ্যস্ত করিয়াছেন। (শ্রীচৈতন্য শতকম্ ৬৪) শুধু তাই নয় শ্রীচৈতন্য শতকমের প্রতি পরতে পরতে সার্বভৌম ভট্টাচার্য বলেছেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হরিনাম প্রচার করেছেন। এখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাক্যকেও লেখিকা কী অপ্রামাণিক বলবেন? এরপর তিনি লিখেছেন, “গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা চৈতন্যদেব নন। এটার প্রতিষ্ঠাতা বলদেব বিদ্যাভূষণ।” ➤ মূর্খের ন্যায় বক্তব্য। শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ প্রচারের মাধ্যমে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণপাদ সেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত "অচিন্ত্যভেদাভেদ" এর উপর বেদান্তসূত্রের গোবিন্দভাষ্য করে সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেন। এর অর্থ তিনি প্রতিষ্ঠাতা হয়ে গেলেন সেটা একটা ভুল ও বানোয়াট কথা। তিনি আরও লিখেছেন, “চৈতন্যদেব, অদ্বৈতাচার্য গোস্বামী, ও নিত্যানন্দ, এই তিনজন যে শৈব মতাবলম্বী ছিলেন, এটার প্রমাণ চৈতন্যচরিতামৃত থেকে দিতে পারা যাবে।” ➤ কিন্তু তিনি কোন রেফারেন্সই দেন নি। আর এই উদ্ভট থিয়োরি যে সম্পূর্ণ বানোয়াট সেটা আগেই দেখানো হয়েছে এবং চৈতন্যচরিতামৃত শাস্ত্রাদি পাঠ করলে যে কেউই সেটা বুঝতে পারবে। তিনি লিখেছেন, “নিত্যানন্দকে চৈতন্যচরিতামৃতে নিত্যানন্দ অবধূত বলা হয়েছে। অবধূত উপাধিটিও তান্ত্রিকদের উপাধি।” ➤ হ্যাঁ, অবধূত বলা হয়েছে। কিন্তু কি কারণে বলা হয়েছে সেটা লেখকের বোধগম্য নয়। তন্ত্রোক্ত শৈবাবধূত ( যাঁহারা পূর্ণাভিষেক অবধূত) এর সাথে নিত্যানন্দের অবধূত কে এক করে গুলিয়ে ফেলেছেন লেখক। অবশ্য এই মন্তব্য করার পিছনের প্রচ্ছন্ন কারণটিও যে বিদ্বান সমাজের অজানা নয় ! তাদের ধারণাটিই এমন যে, " নিতাইচাঁদ শ্রীকুলের সাধক ছিলেন, মাথায় জটা আর তাতে ত্রিপুরসুন্দরী, নর্মদেশ্বর এবং গলায় অনন্তশালগ্রাম নিয়ে ঘুরতেন।" [স্পষ্টীকরণঃ প্রামাণিক জীবনীসাহিত্য ও মহাজন পদাবলীতে সর্বত্র নিতাইচাঁদের চাঁচর কেশের বর্ণনা আছে। তিনি কখনো কখনো দণ্ড, কমণ্ডলু নিয়ে ঘুরতেন। মহাপ্রভু স্বপ্নে তাঁকে গদাধারী দেখেছিলেন। এছাড়া নিত্যানন্দ প্রভুর ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র ও নীলকন্ঠ শিব ওনাদের বংশের কুলদেবতা । নিত্যানন্দ প্রভুর অষ্টম পুর্বপুরুষ বৃষকেতু পন্ডিতের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এটি। তিনি শ্রীকুলের সাধক ছিলেন। নিত্যানন্দ প্রভুর ব্যক্তিগত সেবিত হলো অনন্তশালগ্রামজীউ , যা তিনি গন্ডকী হতে প্রাপ্ত হন] তাই তাঁকে এক তান্ত্রিকের কাতারে ফেলতে যাওয়া এক প্রকার বোকামি বৈ কিছুই নয়। নিত্যানন্দ স্বয়ং বলরাম। তিনি গুরুতত্ত্ব। শ্রীমন্মহাপ্রভুর লীলাপুষ্টিতেই তাঁর বিশেষ অবতরণ। তাঁর "অবধূত" উপাধিটি কোন তান্ত্রিকদের উপাধি নয়। "অবধূত" অর্থে যিনি এই জড় সংসারবন্ধনের ঊর্ধ্বে, যিনি নিত্য আত্মানন্দে নিমগ্ন। চতুঃআশ্রমের অধিভুক্ত নন যিনি অর্থাৎ কোনরূপ আশ্রমাদির অভিমানে আবদ্ধ না থাকায় তাঁকে শাস্ত্রে নিত্যানন্দ স্বরূপ বলা হয়েছে। তিনিই অবধূত। ভাগবতে অবধূত ব্রাহ্মণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া অবধূত শব্দের অর্থ যিনি বিধিনিষেধের অতীত। সাধারণ বিচারে অকরণীয় কার্য্যও অবধূত করে থাকেন। "অব" অর্থে নীচ ও "ধূত" অর্থে যিনি পবিত্র করেন। নীচ বা অপবিত্র কে যিনি পবিত্র করেন, তাঁদের আচরণে সময় বিশেষ কদাচার দেখা গেলেও, তাঁরা নিত্যই শুদ্ধ বা পবিত্রই থাকেন। ( শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার "অপিচেৎ সুদুরাচারো" শ্লোক দ্রষ্টব্য ) অর্থাৎ এই অবতারে নিতাইচাঁদের উক্ত বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়, তিনি আচণ্ডালে এমনকি জগাইমাধাই এর মতো পাপিষ্ঠ কেও প্রেমধন দান করে কৃতার্থ করেছেন। সেজন্যই শাস্ত্রে তাঁকে "অবধূত" বলা হয়েছে। সর্বশেষ মহাপ্রভু-কে শৈব প্রমাণ করার জন্য তিনি কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছেন, শিবের গৌরব বুঝায়েন গৌরচন্দ্র। এতেক শঙ্কর প্রিয় সর্বভক্তবৃন্দ।। না মানে চৈতন‍্য পথ বোলায় বৈষ্ণব। শিবের অমান্য করে ব‍্যর্থ তার সব।। " আবার শ্রী শ্রী হরিভক্তি বিলাসে বলা হয়েছে -- মদ্ভক্ত শঙ্কর দ্বেষী-মদ্বেষী- শঙ্করপ্রিয়ঃ। উভৌ তৌ নরকঃ যাতো যাবচ্চন্দ্র দিবাকরৌ।। ➤ কিন্তু এগুলো দিয়ে কী মহাপ্রভু শৈব এমন কিছু আদৌ বোঝায়?😏 পুরাণাদিতে এমন বহুস্থানে দেখা যায় যে শ্রীকৃষ্ণ শিবকে নিজের সখা বলছেন, এবং তার প্রশংসা করছেন। তাই বলে তিনি শৈব মতাবলম্বী হয়ে গেলেন? কখনোই না। আর শ্রীকৃষ্ণই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (প্রমাণ আগেই দেয়া হয়েছ) কাজেই উপরের উদ্ধৃতিগুলো যেখানে শিবের গুণগান দেখা যাচ্ছে সেগুলো দিয়ে কখনোই এমনটা প্রমাণিত হয়না যে মহাপ্রভু শৈব মতাবলম্বী ছিলেন। সর্বশেষ তিনি লিখেছেন, “ওঁ ঈশানঃ সর্ব্ব বিদ‍্যানামীশ্বরঃ। সর্ব্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতি ব্রহ্মা শিবোমেহস্তু সদাশিব ওঁ।। " -- হরিভক্তি বিলাস 17/46 ➤ এখানে মূলত মালা সংস্কার বিষয়ে বলা হয়েছে। আর হরিভক্তিবিলাস পূর্বাপর অধ্যয়ন করলে দেখা যায় এখানে রুদ্রাক্ষের সংস্কার বিষয়ে কথিত হইয়াছে। লেখিকার অন্তত এটুকু জানা দরকার ছিল যে বৈষ্ণবগণ সাধারণত জপ রুদ্রাক্ষ নয় তুলসী, বেল, নিম্ব ইত্যাদি কাষ্ঠ কিংবা পদ্মবীজ মালায় জপ করে থাকেন। কাজেই তার এসকল কুযুক্তির কোনটাই ধোপে টেকার মতো নয়। ✒️ দেবাশীষ বিশ্বাস ✒️ Ⓒ︎𝐕𝐀𝐒𝐔𝐃𝐄𝐕𝐀𝐒𝐓𝐑𝐀

 
 
 

প্রক্ষিপ্তবাদী: মহাশয়, ভগবদগীতাটা যে ভীষ্মপর্বে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহা জানেন?


প্রতিবাদী: কি করিয়া জানিব, কাহাকেও প্রক্ষিপ্ত করিতে দেখিনাই, শোনা কথারও কোনো মূল্য নাই, প্রক্ষেপের যুক্তিও খুজিয়া পাই না।


প্রক্ষিপ্তবাদী: ভীষ্মপর্বের যে স্থানে গীতা সন্নিবেশিত আছে, সে স্থানে গীতা উঠিবার কোনো প্রসঙ্গই নাই।

প্রতিবাদী: যুদ্ধের ১ম দিন হউক আর ১০ম দিন হউক, “আমার পুত্রেরা ও পাণ্ডবেরা যুদ্ধ করিবার ইচ্ছায় কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইয়া প্রথমে কি করিল?” ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রশ্নই তো গীতা উঠিবার প্রসঙ্গ, এইরূপ প্রসঙ্গ লইয়াই তো মহাভারতের এবং অন্যান্য গ্রন্থের উপাখ্যানগুলি উঠিয়াছে।



প্রক্ষিপ্তবাদী: উভয়পক্ষের যোদ্ধারাই অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া আপন আপন সেনাপতির আদেশের প্রতিক্ষা করিতেছেন, এমন সময় উভয় সৈন্যের মধ্যস্থানে থাকিয়া পাণ্ডবপক্ষের প্রধান সহায় কৃষ্ণ গীতা বলিতে আরম্ভ করিলেন,আর প্রধান যোদ্ধা অর্জ্জুন তাহা শুনিতে লাগিলেন। ‘ধান ভানিতে মহীপালের গীত আরম্ভ হইয়া গেল’। এমন ঘটনা কি কখনো সম্ভবপর হইতে পারে?


প্রতিবাদী: ভীষ্মপর্বের ১ম অধ্যায়ে যুদ্ধের নিয়মাবলী বর্ণিত হইয়াছে: “সমাভাষ্য প্রহর্তব্যং ন বিশ্বস্তে ন বিহ্বলে” অর্থাৎ আমরা বলিয়া কহিয়া বিপক্ষের উপর প্রহার করিব এবং কোনো বিপক্ষ বিশ্বস্ত বা বিহ্বল থাকিলে তাহার উপর প্রহার করিব না। সুতরাং কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের এইরূপ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তাহাদিগকে না জানাইয়া কেহই প্রহার করিবে না। অতএব তাহারা নিরুদ্বেগ ছিলেন বলিয়া তাহাদের অধ্যাত্মবিষয়ক আলোচনাও সম্ভবপর হইয়াছিল।


প্রক্ষিপ্তবাদী: যে দুর্য্যোধন বাল্যকাল হইতে বিদ্বেষের বশবর্তী হইয়া পাণ্ডবদিগকে বিষপ্রয়োগ, জলে নিক্ষেপ এবং অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়াছে, তার উপর বিশ্বাস করিয়া ঐসময়ে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের মত বুদ্ধিমান লোকদের অন্যমনষ্ক হওয়া কিভাবে সম্ভবপর ?


প্রতিবাদী: সেসময় ভীষ্ম কৌরবপক্ষের সেনাপতি ছিলেন এবং তাহার আদেশ ব্যতিত কৌরবপক্ষের কাহারও কিছু করিবার ক্ষমতা ছিলনা। তাছাড়া কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন কচি খোকা ছিলেন না। উভয়েই অতিরথ ও অদ্বিতীয় মহাবীর ছিলেন একথা সকলে জানিত। অতএব দৌড়াইয়া যাইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করিবার সাহস বা তীর নিক্ষেপ করিবার দুঃসাহস কাহারও হয় নাই, কিংবা তাহারাও সেইরূপ আশঙ্কা করেন নাই।তাই তাহাদের গীতার আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটেনাই।


প্রক্ষিপ্তবাদী: পুরাণরচয়িতা বেদব্যাস চিরকাল উপাখ্যান লিখিয়া আসিয়াছেন, তিনি যে গীতার মতো সমস্ত সম্প্রদায়ের উপযোগী গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন ইহা কি করিয়া বিশ্বাস করি?


প্রতিবাদী: বেদব্যাস কেবল পুরাণই রচনা করেন নাই, অধ্যাত্মবিষয়ক চরম গ্রন্থ বেদান্তসূত্র বা ব্রহ্মসূত্র এবং পাতঞ্জলভাষ্য প্রভৃতিও লিখিয়ায়াছেন। বেদব্যাসের মতো তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী ভারতবর্ষে অদ্বিতীয়।


প্রক্ষিপ্তবাদী: গীতার মৌলিকতাসম্বন্ধে কোনো নির্দোষ যুক্তি আছে কি?

প্রতিবাদী: মহাভারতের পূর্বাপর স্থানগুলো পর্য্যালোচনা করিলে দেখা যায়, অন্যান্য স্থানে যেরূপ ভাষা, যেরূপ ভাব, যে প্রকার ছন্দ এবং অপাণিনীয়(আর্ষ) প্রয়োগ আছে, গীতাতেও সেইরূপ আছে।


প্রক্ষিপ্তবাদী: এ বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদও আছে।

প্রতিবাদী: শঙ্করাচার্য, রামানুযাচার্য, মধ্বাচার্য, শ্রীধরস্বামী প্রভৃতি যোগী মহাপুরুষগণ নিঃশঙ্কচিত্ত্বে গীতার ভাষ্য ও টিকা রচনা করিয়ছেন, ইহাতেও গীতার মৌলিকতাই প্রমাণিত হয়।


প্রক্ষিপ্তবাদী: মহাভারত রচনার পর কোনো বিদ্বান ব্যক্তি আধ্যাত্মিক শ্লোকগুলি একত্র করিয়া, মধ্যে মধ্যে নিজেও কিছু লিখিয়া ‘ভগবদগীতা’ নাম দিয়া ভীষ্মপর্বে সন্নিবেশিত করিয়াছেন।


প্রতিবাদী: তাহা অসম্ভব। কারণ মহাভারতের আদিপর্বের ২য় অধ্যায়-‘পর্বসংগ্রহ অধ্যায়’। সেখানে কোন পর্বে কতগুলি অধ্যায়, কতগুলি শ্লোক, কতগুলি উপপর্ব এবং কি কি বৃত্তান্ত আছে, তাহা মহর্ষি বেদব্যাস নিজেই সূচিপত্রের ন্যায় লিখিয়া গিয়াছেন। সেখানে উল্লিখিত:

“পর্ব্বোক্তং ভগবদবদগীতা পর্ব্ব ভীষ্মবধস্ততঃ”।


পরবর্তীতে আছে:

“কশ্ললং যত্র পার্থস্য বাসুদেবো মহামতিঃ।

মোহজং নাশষামাস হেতুভির্মোক্ষদর্শিভিঃ।।”


আশ্বমেধিকপর্বে অনুগীতাপ্রকরণে স্বয়ং কৃষ্ণই অর্জ্জুনকে বলিয়াছেন-

“পূর্ব্বমপ্যেতদেবোক্তং যুদ্ধকাল উপস্থিতে।

ময়া তব মহাবাহো তস্মাদত্র মনঃ কুরু।।”(আশ্বঃ ৫১/৪৯)



অতএব আদিপর্বে ভগবদগীতাকে একটি উপপর্ব বলিয়াছেন, আবার কৃষ্ণ আশ্বমেধিকপর্বে অনুগীতাপ্রকরণে অর্জ্জুনকে সেই ভগবদগীতার বিষয়ই স্মরণ করাইতেছেন। এ অবস্থায় কোনোভাবেই ভগবদগীতাকে সংগ্রহগ্রন্থ কিংবা প্রক্ষিপ্ত বলা যায় না।

প্রক্ষিপ্তবাদী: (ঈষৎ হাস্য করিয়া) যদি এই অংশগুলিকেও প্রক্ষিপ্ত বলি?

প্রতিবাদী: তাহা হইলে সম্পূর্ণ মহাভারতটাকেই কিংবা নিজেকেই প্রক্ষিপ্ত বলিয়া আমাকে নিষ্কৃতি দিয়া যান।


ree

 
 
 
Be Inspired
International Mula Gaudiya Sampraday Trust 

Write Us

For Any Assistance Or  Query Please Email Or Call To Us

Imgaudiyas@gmail.com

+918439217878

Vrindavan,Uttar Pradesh, India

  • Facebook
  • Facebook
  • YouTube Social  Icon
  • Whatsapp social icon
  • YouTube Social  Icon
  • Twitter Social Icon
  • instagram social icon
  • Facebook Social Icon

Success! Message received.

bottom of page