কোন ব্যক্তি ভগবদ্ ভজনের আশায় কোন সাধুমহাপুরুষের শরণাপন্ন হন । সাধু পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন লোকটীর মনে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানবিদ্ বলিয়া অভিমান আছে । এই অভিমান ভক্তিমার্গের প্রধান অন্তরায় । এজন্য লোকটিকে বলিলেন— জগতে সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে তোমার অপেক্ষা নিকৃষ্ট কোন বস্তু সপ্তাহের মধ্যে আমার নিকট লইয়া আইস । সাধুর আদেশানুসারে ঐ ব্যক্তি বস্তু তত্ত্ব আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়া যে বস্তুর সহিত নিজের তুলনা করিতে যান, নিজেকেই নিকৃষ্ট মনে হয় অথচ সাধুর নিকট গমন করিবার প্রতিশ্রুতি সময়ও শেষ হইয়া আসিয়াছে । অগত্যা রিক্ত হস্তে যাওয়াই সমীচীন মনে করিলেন । অতঃপর পরদিন প্রাতঃকালে শৌচাদি ক্রিয়া সমাপন করিবার জন্য বহির্দ্দেশে গমন করিলেন । কিন্তু শৌচক্রিয়ায় বসিবার সময় ভাবিতে লাগিলেন আমার শরীর হইতে নির্গত এই মলই নিকৃষ্ট আবার ইহার মধ্যস্থিত কীটাণু সকল আমা হইতেও নিকৃষ্ট । যাহা হউক এই সিদ্ধান্তে
অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলেন বটে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল যে বিষ্ঠা যেন উপহাস করিয়া বলিতেছে আমি কিপ্রকারে তোমার শরীর হইতে নিকৃষ্ট হইলাম । আমি সকলের স্পৃহনীয় সুস্বাদু উত্তম খাদ্য সামগ্রী ছিলাম কিন্তু তোমার শরীরের সঙ্গ বশতঃ আমার এই দুর্দশা হইয়াছে । আর আমার মধ্যে যে সকল কীটানু বাস করিতেছে তাহাদিগকে যে তোমা হইতে নীচ বলিয়া মনে করিতেছ ইহাও তোমার মূর্খতার পরিচয় । যেহেতু তুমি এই অস্থি, মাংস, বিষ্ঠা, মূত্র পরিপূরিত কৃমি সঙ্কুল স্থূল শরীরে অনাদি কাল হইতে বাস করিয়াও ইহার কোন ক্ষুদ্রতম অংশকে শুদ্ধ করিতে পারিলে না । আমার মধ্যস্থিত কীট সমূহের শক্তি পরীক্ষা করিয়া দেখ উহারা অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে কেমন শুদ্ধ পদার্থে পরিণত করে । অর্থাৎ পুরীষের কীট সকল পুরীষকে মৃত্তিকায় পরিণত করে, কোন স্থলে উদ্ভিজ্জের সাররূপে পরিণত করিয়া মনুষ্যগণের কৃষি সম্পদের সহায় হয় । আমি কিন্তু তোমার মধ্যে বাস করিয়া এবং তোমার সংস্পর্শে অর্থাৎ নরকতুল্য তোমার উদরের মধ্যে থাকিয়া এই অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছি । যদি গাভী প্রভৃতির উদরেও স্থান পাইতাম তাহা হইলেও কিঞ্চিৎ পবিত্র হইতে পারিতাম কিন্তু তোমার স্পর্শশক্তি আমাকে অনুমাত্র শুদ্ধ করিতে পারে নাই বরং তুমি অভিমান বশতঃ নিজেকে শুদ্ধভান করিয়া আমাকে ঘৃণা করিতেছ । ইহা অপেক্ষা বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে ?
তখন সেই ব্যক্তি সাধুর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন—
প্রভো ! আমার অপেক্ষা নিকৃষ্ট বস্তু আর কিছুই নাই । শ্ৰীপাদ কবিরাজ গোস্বামীর উক্তি—“পূরীষের কীট হৈতে মুঞি সে লঘিষ্ঠ” ইহা পরম সত্য । সাধু কৃপা করিয়া উপদেশ দিলেন নিজের অভিমান ও সর্ব বিধ সামর্থ্য পরিত্যাগ করিয়া অকিঞ্চনভাবে শ্ৰীভগবানের শরণাপন্ন হও তাঁহার কৃপায় শীঘ্র ভক্তিলাভে কৃতার্থ হইবে ।
সৰ্বসামর্থ্য পরিত্যাগ পূর্বক তাঁহার কৃপার প্রতি লক্ষ্য করিয়া ভজন করিবে। তিনি যাহা করাইতেছেন তাহাই করিতেছি । এই ভাবে সৰ্ব্বদা তাহার কৰ্ম্ম করিবে । তিনি যাহাই করাইতেছেন তাহাই করিতেছি— ইহার অর্থ বোধ বড়ই দুর্গম । তিনিই করাইতেছেন কি আমার স্বতন্ত্র কৰ্ম্ম শক্তি হইতে এই সকল কাৰ্য্য হইতেছে ? ইহা নিরুপণ করিতে হইলে যেখানে দেখিবে সাধু শান্ত্র গুরু বাক্য সম্মত যে কাৰ্য্য তাহাই তিনি করাইতেছেন। আর যে কাৰ্যগুলি শাস্ত্র বহিভূত তাহাই নিজ প্রারব্ধ সম্ভূত । অতএব পৃথক মনোবৃত্তি ত্যাগ করিতে হইবে ।
অকিঞ্চনত্ব বলিতে স্বীয় ইন্দ্রিয় ভােগ্য বিষয় ত্যাগ অর্থাৎ চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ও ত্বকের বিষয় রূপ শব্দ গন্ধ রস ও স্পর্শ, এই অতি তুচ্ছ মৃগ তৃষ্ণার মত মায়াময় সুখ হইতে আরম্ভ করিয়া অমায়িক ব্রহ্মানন্দ বা সালোক্যাদি মুক্তিসুখ পর্যন্ত পরিগ্রহ বাসনা ত্যাগ করার নাম আকিঞ্চনত্ব।
এই অকিঞ্চন বুদ্ধি স্থায়ী হইলে প্রেমভক্তিলাভের জন্য প্রবল উৎকণ্ঠা জাত হয় এবং নিজেকে পথের কাঙ্গাল মনে হয় । যেরূপ পথের কাঙ্গাল যাহাকে দেখে তাঁহার নিকটেই (যোগ্যাযোগ্য বিচার না করিয়া, ধনবান ভাবিয়া ) ধন প্রার্থনা করিয়া থাকে সেই প্রকার এই বিশ্ব মাঝে মহাপ্রভুর কৃপায় স্থাবর জঙ্গম সকলেই প্রেমবান একমাত্র আমিই প্রেম ভক্তির কাঙ্গাল । এই ভাবে সকলের কাছেই শ্রীকৃষ্ণভক্তি সম্পদ প্রার্থনা করেন। প্রাণীমাত্রে দণ্ডবৎ প্রণতি করেন । ইহাই প্রকৃত বৈরাগ্যের লক্ষণ ।