UA-199656512-1
top of page

❤️* #বঙ্গে_নবজাগরণের_নায়ক_চৈতন্যদেব *❤️

"(#পর্ব_০৩)"


"#চৈতন্যযুগের_চৈতন্যময় অান্দোলন অাপামর বাঙালীজনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত সর্বাত্মক বৈপ্লবিক চেতনার প্রথম এবং সার্থক উন্মেষ ৷ ইতিহাস বলছে , বাঙালী চিত্তের বহু বহু শতাব্দী ধ'রে সঞ্চিত ক্লেদকলুষকে হরিচরণাশ্রিত প্রেমের বণ্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অমিত সুদর্শনতনু ও বিশাল পুরুষাকারসম্পন্ন এই জনগণমন—অধিনায়কের বিপ্লব"'*৷ #বাংলার প্রথম এই রুদ্রসম—তেজস্বী মহাবিদ্রোহীর কণ্ঠেই সার্থক উদ্ গীত হয়ে উঠেছিল যুগ যুগ ব্যাপী লাঞ্ছিত, নিপিড়ীত ও অবহেলিত মানবাত্মার প্রতিবাদের ভাষা—নাম—সংকীর্তন"'*৷ '#কায়েমি স্বার্থ—সর্বস্ব বিরুদ্ধবাদীদের সকল অাপত্তির কোলাহলকে ছাপিয়ে , অত্যাচারী শাসকের সকল নিষেধাজ্ঞাকে স্তম্ভিত ক'রে, অাকাশ—


বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল বাংলায় প্রথম এই সার্থক সাম্যের গান"'*৷~~~~~~ ~~~~~~*"'#ইতিহাস স্বীকার করেছে , তথাকথিত বাঙালী জাতিকে অধঃপাতে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য যেমন "কোমলে কোমল ও কঠোরে কঠোর" এক মহামানবের প্রয়োজন ছিল , অভাবিত ভাবেই , তেমনই এক কল্পনাতীত মহামানবিক সত্তা নিয়েই অাবির্ভূত হয়েছিলেন এই প্রথম সমাজ—সংস্কারক;— **"'#তদানীন্তন_বিদ্যাজীবী ভক্তগণ বহু শাস্ত্রীয় প্রমানাদির সম্ভারে শ্রীভগবানের লীলাবিগ্রহরূপে তাঁর অাবির্ভাবের সেই বিশাল বিশ্বাসকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতেও প্রয়াসী হয়েছিলেন ৷ এর উপরে ছিল সত্যাশ্রয়ী মহাপ্রভুর স্ব—মুখেই পরিব্যক্ত অাত্মতত্ত্ব—"' মুঞি কৃষ্ণ মুঞি রাম মুঞি নারায়ণ"'***৷~~~~~~~ ***"'#এই_যুগে যজ্ঞাদি বৈদিক ক্রিয়াকর্মে নয় , কেবলমাত্র "হরে কৃষ্ণ হরে রাম" নামগানেই জীবের মুক্তি—শ্রীমন্মহাপ্রভু কণ্ঠে উদ্ গীত হয়ে উঠেছিল এই মহামন্ত্র"'***~~~~~ ~~~***"' #তাঁর_সময়কাল থেকে অদ্যাবধি সকল ভক্তের হৃদয়ে পরম চৈতন্যোদ্দীপক এই মহামণ্ত্রটির প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাসের অালো এমনই অবিশ্বাস্য প্রাখর্যে অাকীর্ণ হয়ে অাছে যে , *সহস্র নিরীশ্বরবাদের তিরস্করণীতেও তা অাবৃত করা যায়নি ৷*—'পরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনম্'৷ ~~~~~~~~~~~~~~ ***"'#শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দরের অধ্যাত্ম—সাধনার অনুসারী সাধক—গবেষকগণ অাজও স্বীকার করছেন যে , পাঁচশো বছরেরও অাগে এই বঙ্গে শ্রীমন্মমহাপ্রভুর পদচারণা সত্যই এক অপূর্ব সংবাদ , একটি অলৌকিক ঘটনা , একটি অদৃষ্টপূর্ব মহাসত্যের অবতরণলীলা"'***~~~~ ~~***"' #শুধু_বঙ্গ_নয় , ভারতবর্ষের একটি বিরাট ভূখণ্ডের মানুষ সেই যেন প্রথম দর্শন করল স্বয়ং শ্রীভগবান্কে , প্রত্যক্ষ করল অসীম ভগবত্তাকে , হৃদয় দিয়ে অনুভব করল অলোকসামান্য ঈশ্বরত্বের অনাস্বাদিতপূর্ব মধুরিমা ৷ তাঁর গুরুগণও তাঁকে গুরুরূপে বরণ করে ধন্য হলেন"'*** ৷ ~~~~~~

~~

~~~~~~~~

***"'#যে_অন্ধ তমিস্রা , ভীরুতার গ্লানি বঙ্গভূমিকে তখন অাবিষ্ট করে রেখেছিল তাকেই অাঘাত করে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের অভ্যুদয় হয়েছিল"'*** ~~~~~~~~~~ "'#ভারতভূমিতে হৈল মনুষ্যজন্ম যার ৷

জন্ম সার্থক করি,কর পর—উপকার"'॥

~~~~~***"'#শ্রীচৈতন্যদেব এক নব চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন ৷ যাঁরা ধর্মবিশ্বাসী নন, যাঁরা নাস্তিক তাঁরা ঈশ্বরকেন্দ্রিক জাগৃতিকে 'রেনেসাঁ' বলতে সন্মত নন ৷ তাঁরা মনে করেন যে শিল্প—কলা, মানুষের ইহ জীবনের চিন্তাধারায় প্লাবনের জোরে যে পরিবর্তন সেটিই হল 'রেনেসাঁ' ৷ এটি একদেশদর্শিতা ৷ ধর্মকে এবং ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেও অাপামর জনগণের মনে চিন্তাপরিবর্তনের প্লাবন ঘটতে পারে , যা কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং সেটিও অবশ্যই নবজাগৃতি বা "রেনেসাঁ"৷

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য তাই ঘটিয়েছেন ৷ মানুষের মনের জড়তাকে কাটিয়ে তিনি প্রেমের প্লাবন এনে দিয়েছেন ৷ জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি এবং সেই ভক্তি উদ্দীপনের জন্য নাম—সংকীর্তন—এরই উপর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত"'***

~~~~~~~~~

#নগরে নগরে অাজি করিব কীর্তন ৷

সন্ধ্যাকালে সবে কর নগরমণ্ডন॥

সন্ধ্যাতে দেউটি যত জ্বাল ঘরে যরে ৷

দেখি কোন কাজী অাসি মোরে মানা করে ॥


~~~~~***"'#এই_যে_শাসনের বাধা না মানার অাহ্বান, এই বিদ্রোহ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যেরই শিক্ষা ৷ তিনি সেবা কর্কে নিমগ্ন হতে বলেছেন এবং বিধর্মীরা যে তীর্থসমূহ ভেঙ্গে দিয়েছে সেগুলিকে অাবার গড়ে তুলতে অাহ্বান করেছেন"'৷

~~~~~~~~~~~

***"'#শ্রীচৈতন্যদেব ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দে নবদ্বীপধামে জন্মগ্রহণ করেন ৷ তাঁর বাবার নাম শ্রীজগন্নাথ মিশ্র এবং মায়ের নাম শচী দেবী ৷ কিন্তু জন্মের পাঁচশো (অধিক) বছর পরেও যাঁর প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি সেই মহাপুরুষের জীবন সম্পর্কে এইসব বাস্তব তথ্যের চেয়ে অনেক বড় ভাব সত্য হল সমগ্র বাঙালী জাতির "হিয়া—অমিয় মথিয়া" তিনি কায়া ধরেছিলেন"'***

~~~~***"'#তাঁর_জীবনকালের পরবর্তী বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সর্বব্যাপ্ত প্রভাব নিয়ে তাঁর উজ্বল উপস্থিতি ৷ অার সাধক অধ্যাত্ম—পথচারী বৈষ্ণব—জনেরা জানেন, "বরজ যুবতী—ভাবের ভকতি"—র মাহাত্ম্য নিজের জীবনে প্রকটিত করে তিনি যেমন "রাধার মহিমা, প্রেমরসসীমা" জগতে জানিয়ে গেছেন, তেমনই সেই দুর্লভ প্রেমসম্পদ অকাতরে বিণ করেছেন সর্বজনের মধ্যে , সমাজের উচ্চতম স্তরের থেকে "সবার পিছে, সবার নীচে" থাকা সর্বহারাদেরও,—তাঁর অাবির্ভাব তাই কলিতাপদগ্ধ জীবকুলের উদ্ধারকল্পে এক অসীম ঐশী করুণার অভিবর্ষণ ৷ তাই এই ঘরের ছেলের চোখে "বিশ্বভূপের ছায়া" দেখেছে বাঙ্গালী , বিশ্বাস করেছে , "গৌরাঙ্গ মধুর লীলা , যার কর্ণে প্রবেশিলা , হৃদয় নির্মল ভেল তার"***৷


~~~~~~~~***"'#এদেশের সুপ্রাচীন উদার ধর্মের যে স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতোধারা প্রতিকুল রাজশক্তির অত্যাচার তথা বহুবিধ অারোপিত বিধি—নিষেধ অাচার—বিচারের পাষাণকায়ায় অবরুদ্ধ হয়ে নির্জীব ও মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিল"'***৷তাকে—~~~~~~~~~~ খাইতে শুইতে যথা তথা নাম লয়

দেশ—কাল নিয়ম নাহি সর্বসিদ্ধি হয় ॥

~~~~***"'#এহেন_অশ্রুতপূর্ব বৈপ্লবিক উদ্দীপনায় সঞ্জীবন—মন্ত্র শুনিয়ে তার মধ্যে নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার করে গণজীবনের সর্বস্তরে তার বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছিলেন যিনি , এবং তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ তাঁর প্রচারিত ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের নামটিও দেশে দেশে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে এমনভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে অাছে যে—

পৃথিবীতে যত অাছে নগরাদি গ্রাম ৷

সর্বত্র প্রচারিত হইবে মোর নাম॥

~~~~তাঁর এই উক্তিও অাজ বহুলাংশে বাস্তবায়াত হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে , সেই "রাধাভাবদ্যুতি—সুবলিত কৃষ্ণস্বরূপ"'***৷

~~~***"'শ্রীমদ্ভাগতের মুখ্য শ্লোক—"'এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ং"' ৷ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান"'***৷

~~~~~~~~~~

***"'গৌড়ীয় বৈষ্ণব মহাজনগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণই শ্রীচৈতন্যদেব ; তিনি "রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্"৷ অর্থাৎ শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের মিলিত তনুই শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ৷ তিনিই "স্বয়ং ভগবান" ৷ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যই যে শ্রেষ্ঠ পরতত্ত্ব—সিদ্ধান্তের এই সুদৃঢ়তাই তাঁর কৃপাপ্রাপ্তির একমাত্র উপায় ৷ তাঁর নির্দেশিত ও অাচরিত "শ্রীশ্রীহরিনাম সংকীর্তন" অর্থাৎ—

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে"

"হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে"॥—

এই নাম সাধ্য ও সাধন ৷ "নাম সংকীর্তন কলৌ পরম উপায়" অর্থাৎ কলিকালে একমাত্র হরিনাম সংকীর্তনই পারে জীবের স্বরূপ স্মৃতি জাগরিত করে মায়াবন্ধন ঘুচিয়ে "অকৈতব কৃষ্ণপ্রেম" দান করতে ৷ কলিতে একমাত্র হরিণাম সংকীর্তনকারীই "সুমেধা"র অধিকারী—

~~~~~~~~~~~~

সংকীর্তন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য৷

সংকীর্তন-যজ্ঞে তাঁরে ভজে সেই ধন্য ॥সেই ত সুমেধা অার কুবুদ্ধি সংসার ৷সর্ব যজ্ঞ হৈতে কৃষ্ণনাম—যজ্ঞ সার ॥ "'***~~~~

~~~~~~~~~

~~~~"'সাধু—গুরু বৈষ্ণবের

চরণে দণ্ডবৎ প্রণাম"'~~~~

 
 
 

" (#প্রবন্ধ)"


#বঙ্গে_নবজাগরণের_নায়ক_চৈতন্যদেব ৷"

"(#পর্ব_০২)"


#জাত_বৈষ্ণবদের_দীক্ষার প্রকরণও খুব সরল ৷ গুরু বা মঠধারী বা ভেক-গোসাই শিষ্য-শিষ্যার কানে একাক্ষরী মন্ত্র দেন, শিষ্যের হাতে দেন ডোরী, কৌপিন ও বহির্বাস ৷ তার গলায় পরিয়ে দেন তুলসীর মালা ৷


#কীর্তনগানের_ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যদেবের অবদান;—


*#শ্রবনং_কীর্তনং_বিষ্ণোঃ_স্মরণং_পাদসেবনম্ ৷*

*অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ॥*

*ইতি পুংসার্পিতা বিষ্ণৌ ভক্তিশ্চেন্নবলক্ষণা ৷ ক্রিয়তে ভগবত্যদ্ধা তন্মন্যেহধীতমুত্তমম্॥* (ভাগবত-৭/৫/২৩-২৪শ্লো;)"

#আমাদের_দেশে

একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে শ্রীচৈতন্যদেবই কীর্তন গানের প্রবর্তক ৷ #কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই যে কীর্তন ও সংকীর্তন শব্দ দুটি প্রচলিত ছিল ,তাঁর বহু প্রমাণ আছে ৷ প্রহ্ণাদের(উবাচ) উপাখ্যানে এই শ্লোকে দেখা যাচ্ছে হিরণ্যকশিপুর প্রশ্নের উত্তরে প্রহ্লাদ যে নবধাভক্তির কথা বলেছেন তার মধ্যে কীর্তন অন্যতম ৷



#আবার_যুগাবতার_প্রসঙ্গে ঋষি

করভাজন কথনে সংকীর্তন শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে—

*#কৃষ্ণবর্ণং_ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদম্ ৷ যজ্ঞৈঃ সঙ্কীর্তনপ্রায়ৈর্যজন্তি হি সুমেধসঃ॥* (ভাগবত-১১/৫/৩২)"

#কলিযুগে ভগবানের

শ্রীবিগ্রহ কৃষ্ণবর্ণ ৷ নীলকান্তমনিসম তাঁর অঙ্গদ্যুতি; যেন উজ্জ্বলকান্তি ধারার প্রত্যক্ষ দর্শন হয় ৷ তিনি হৃদয় আদি অঙ্গ, কৌস্তুভ আদি উপাঙ্গ, সুদর্শন আদি অস্ত্র এবং সুনন্দ আদি পার্ষদ সকলে সংযুক্ত থাকেন ৷ কলিযুগে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ এমন যজ্ঞ দ্বারা তাঁর আরাধনা করে থাকেন যাতে নাম-গুণ-লীলা সংকীর্তনের প্রাধান্য থাকে ৷

#আবার_গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের অন্যতম প্রবক্তা #শ্রীজীব তাঁর 'তত্ত্বসন্দর্ভ' গ্রন্থে 'ত্বিষা-কৃষ্ণং' শব্দটি ব্যাখ্যা করে এই শ্লোকটির মধ্যে সুস্পষ্ট চৈতন্যদেব আবির্ভাবের ইঙ্গিত দিয়েছেন ৷ শ্লোকটিতে সংকীর্তনকে যাগযজ্ঞের সমকক্ষ বলা হয়েছে যা শ্রীচৈতন্যদেবের শিক্ষার মূল কথা ৷ 'ত্বিষা' শব্দটির অর্থ, দীপ্তি বা কান্তি ৷ যদি ত্বিষা কৃষ্ণং শব্দটি ভাঙ্গা যায় এইভাবে-ত্বিষা+ অকৃষ্ণং তাহলে শ্লোকটির অর্থ দাঁড়ায় কৃষ্ণবর্ণ যে শ্রীকৃষ্ণ দীপ্তি ও কান্তিতে অকৃষ্ণ অর্থাৎ গৌরবর্ণ ধারণ করেছেন এবং সাঙ্গোপাঙ্গ ও পার্ষদদের নিয়ে আবির্ভূত হয়ে সংকীর্তনরূপ যজ্ঞ প্রবর্তন করেছেন ৷ কাজেই নৈষ্ঠিক গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে শ্রীচৈতন্য আবির্ভাবের বহুপূর্ব্বে লেখা শ্রীভাগবতের এই শ্লোকে চৈতন্য আবির্ভাবের ইঙ্গিত স্পষ্ট ৷

#আবার_শ্লোকটির সাধারণভাবে অর্থ করা যায় দীপ্তিময় ও কান্তিময় কৃষ্ণবর্ণের শ্রীকৃষ্ণ ৷ তাহলেও কিন্তু সংকীর্তন শব্দটিকে বাদ দিতে পারি না ৷


#আবার_যদি এই শ্লোকে কৃষ্ণবর্ণ শব্দের অর্থ দুটিকে ত্বিষাকৃষ্ণ শব্দের দুটি অর্থের সঙ্গে মিলালে মোট চারটি অর্থ পাওয়া যায় ৷

যেমন;-(ক) যাঁর বর্ণ কৃষ্ণ এবং কান্তিও কৃষ্ণ, (খ) যিনি কৃষ্ণকে বর্ণন করেন এবং যাঁর কান্তি কৃষ্ণ; (গ) যাঁর বর্ণ কৃষ্ণ, কিন্তু কান্তি অকৃষ্ণ বা পীত বা গৌর এবং (ঘ) যিনি কৃষ্ণকে বর্ণন করেন এবং যাঁর কান্তি অকৃষ্ণ বা পীতবর্ণ ৷

#কিন্তু_প্রথম দুটি অর্থ অসঙ্গত, কারণ কলিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্য বর্ণের দ্বারা আচ্ছাদিত,ছন্ন অবতার, তাই তাঁর কান্তি কখনো কৃষ্ণ হতে পারে না ৷ তাহলে শেষ দুটি অর্থই সঙ্গত,কারণ কলিতে স্বয়ং ভগবান ভিতরে কৃষ্ণবর্ণ,বাইরে পীত বা গৌরবর্ণ; অর্থাৎ তিনি 'অন্তঃকৃষ্ণ বহির্গৌর'৷ তাই 'ত্বিষা কৃষ্ণম্'(সন্ধিহীন) পাঠ সঙ্গত নয়; 'ত্বিষা অকৃষ্ণম্' (সন্ধিবদ্ধ) পাঠই সঙ্গত ৷

আবার- "#রাধায়া_ভবতশ্চ চিত্তজতুনী স্বেদৈর্বিলাপ্য' ইত্যাদি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীবৃন্দাদেবীর উক্তি দ্বারা বুঝা যায়, প্রেমপরিপাক শ্রীরাধাকৃষ্ণের চিত্তকে গলিয়ে এক করে দিয়েছিল;সেই মহাপরাক্রান্ত প্রেমই কৃষ্ণপ্রেমময়ী শ্রীরাধার অঙ্গকেও গলিয়ে যেন তাঁর প্রতি অঙ্গদ্বারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্যামঅঙ্গকে আলিঙ্গন করে পীতবর্ণ করে দিয়েছে, শ্যামসুন্দরকে অন্তঃকৃষ্ণ বহির্গৌর করে দিয়েছে ৷ তাই এই কলির এই অবতার শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলিত বিগ্রহ ৷

*#আবার_আমাদের_দেশে একদল আছেন যাঁরা কোন অংশের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা করতে না পারলেই সেই অংশকে " #প্রক্ষিপ্ত " বা পরবর্তীকালের সংযোজন বলে নিশ্চিন্ত হতে চান ৷*

তাইতো শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে—


*#জীবের_কল্মষ-তমো নাশ করিবারে ৷ অঙ্গ উপাঙ্গ নাম নানা অস্ত্র ধরে*॥(চৈ:চ:-১/৩/৪৭)

#কলিহত_জীবের এই ভক্তিবিরোধী কর্মাসক্তি দূর করবার জন্য শ্রীগৌরাঙ্গ অঙ্গ, উপাঙ্গ ও হরেকৃষ্ণ নাম-রূপ-অস্ত্র নিয়েই অবতীর্ণ হয়েছেন ৷



#যাই_হোক কীর্তন বা সংকীর্তনের ধারা বহু প্রাচীন থেকেই আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল ৷ ভাগবতে উল্লেখ আছে ব্রজবালক কৃষ্ণসখাগণ শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করতেন ৷ রাসলীলায় গোপী গীতের উল্লেখ আছে। মাথুর বিরহকালে ভ্রমর গীতিরও উল্লেখ করা যায় ৷ কাজেই উচ্চৈস্বরে নামযশঃ গান-যাকে বলে কীর্তন-তা একটি প্রাচীন রীতি ৷


#বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণের যুগে রচিত ছোট ছোট সাধন সংগীতগুলি সুর ও তাল সহযোগে গাওয়া হত ৷


#আবার_শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্ব্বে অন্তঃত দুটি কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাব্য রচিত হয়েছে বাংলাদেশে জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' আর বড়ু চণ্ডিদাসের 'শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন' কাব্য

দুটি আখ্যায়িকা কাব্যের রূপে লিখিত হলেও ছোট ছোট গীতির সমষ্টি ৷ আবার মিথিলার কবি বিদ্যাপতির নামও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়—

*#চণ্ডিদাস_বিদ্যাপতি,

রায়ের নাটক গীতি ,

কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ ৷

স্বরূপ রামানন্দসনে,

মহাপ্রভু রাত্রিদিনে ,

গায় শুনে পরম আনন্দ ॥* (চৈ:চ:-২/২/৬৬)


#স্বয়ং_শ্রীচৈতন্যদেব জয়দেব , বিদ্যাপতি , ও চণ্ডিদাসের পদ আস্বাদন করতেন এ কথাও আমরা তাঁর জীবনী কাব্যপাঠে অবগত হই ৷

'আস্বাদন' শব্দটির অর্থ সম্ভবতঃ শুধু আবৃত্তি নয়, সুর ও তাল সহযোগে গান শোনা বা নিজে গাওয়া ৷ সুতরাং শ্রীচৈতন্যদেব আবির্ভাবের পূর্ব্বেই কীর্তন গানের ধারা বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল ধরে নেওয়া যায় ৷


*#তাহলে_কীর্তনগানে_শ্রীচৈতন্যদেবের_অবদান_কি_?*—

#একটু_ধীর_স্থিরভাবে_বিচার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে শ্রীচৈতন্যদেব বাংলাদেশের সেই #বিশিষ্ট_সংগীত_ধারাটিকে- #সুগঠিত_সুবিন্যস্ত_ও_সুসংহত করে তাকে জনগণের হৃদয়ের সামগ্রী করে তুললেন ৷ সেই হিসাবে শ্রীচৈতন্যদেব বাংলার কীর্তনগানের সংস্কারক ৷


*#শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন নিয়ে রচিত চরিত কাব্যগুলির মধ্যে যেমন তত্ত্ব ও দর্শনের দিক থেকে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য-চরিতামৃত শ্রেষ্ঠ, তেমনি আবার ঐতিহাসিকতার দিক থেকে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য-ভাগবত সবচেয়ে বেশী বিশ্বস্ত।*



#কীর্তনগানের ধারাকে কিভাবে শ্রীচৈতন্যদেব জনপ্রিয় ও সুসংহত করে তুললেন তার কিছু কিছু বিবরণ বৃন্দাবন দাস চৈতন্য ভাগবতে দিয়েছেন ৷ প্রথম জীবনে যখন নিমাই পণ্ডিত নবদ্বীপে টোল খুলে ছাত্র পড়াচ্ছেন-তখন থেকেই তাঁর বাংলার এই নিজস্ব সংগীত ধারাটির প্রতি এক আশ্চর্য ভালবাসা জন্মেছিল ৷ তিনি টোলে ছাত্রদের নানা শাস্ত্র শিক্ষা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংকীর্তনও শিক্ষা দিতেন ৷ এ ছাড়া ছাত্ররা জিজ্ঞাসা করত—


*#শিষ্যগণ_বোলেন "কেমন সংকীর্ত্তন ?"৷ আপনে শিখায় প্রভু শ্রীশচীনন্দন ॥* (কেদার-রাগ)

*" হরয়ে নমঃ কৃষ্ণঃ যাদবায় নমঃ ৷ গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন"*


*দিশা দেখাইয়া প্রভু হাথে তাল দিয়া ৷ আপনে কীর্ত্তন করে শিষ্যগণ লৈয়া*॥(চৈ:ভা:মধ্যখণ্ড)

"হরয়ে নমঃ কৃষ্ণঃ"-পদটি নিমাই পণ্ডিত যে ভাবে শিষ্যদের শিখিয়ছিলেন আজও ঠিক সেইভাবেই হাততালি দিয়ে গাওয়া হয় সমস্বরে ৷ ছত্র দুটির এমনই আকর্ষণী শক্তি যে গলা আপনা- আপনিই মিলে যায়, হাত আপনা-আপনিই উঠে আসে ৷


আসলে শ্রীচৈতন্যদেবই বাংলা কীর্তনগানকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করেন এবং কীর্তনগানের ধারাকে গণতন্ত্রীকরণ করেন ৷ এত বড় জনসংগঠক ও জননেতা মধ্যযুগে বাংলায় আর কোথায় ? শ্রীচৈতন্যদেবের যুগ থেকে বাংলাদেশের কীর্তনের ধারায় প্রচলিত হ'ল লীলাকীর্তন বা পালাকীর্তন, নামকীর্তন এবং নূতন ও অভিনব প্রথা সংযুক্ত হ'ল নগর কীর্তন ৷ লীলাকীর্তন হ'ল রাধাকৃষ্ণের রূপ,গুণ, ও বিবিধ মনোহারী লীলার বর্ণনা ৷ নামকীর্তনে শ্রীহরির নাম ও করুণার কথাই প্রধান ৷


শ্রীবাস অঙ্গনে পার্ষদদের নিয়ে শ্রীচৈতন্যদেব কীর্তনগান করতেন,নামকীর্তন করতেন- এ বর্ণনা বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবতে দিয়েছেন ৷ কিন্তু বিরোধীপক্ষ পাষণ্ডীদের তা সহ্য হ'ল না,তাঁরা নগর রক্ষক মুসলমান কাজীর কাছে নালিশ জানালেন ৷ নাম গান কাজীর আদেশে বন্ধ হল ৷ শ্রীচৈতন্যদেব গড়ে তুললেন জনসংগঠন, গণবিক্ষোভ ৷


*"নগরে নগরে আজি করিব কীর্তন ৷ সন্ধ্যাকালে সবে কর নগরমণ্ডন॥* সন্ধ্যাতে দেউটি যত জ্বাল ঘরে ঘরে ৷ দেখি কোন কাজী আসি মোরে মানা করে ॥



এই যে শাসনের বাধা না মানার আহ্বান, এই বিদ্রোহ শ্রীচৈতন্যদেবেরই শিক্ষা ৷ ষোড়শ শতাব্দীর গণ সংগ্রামের রূপ নিশ্চয়ই বর্তমান যুগের মত হয়নি৷ এই গণমিছিলই "নগর সংকীর্তনের" রূপ পরিগ্রহ করল৷ মহাপ্রভুই প্রথম অহিংস আন্দোলনের স্রষ্টা।

এ মিছিলও জনগণের মিছিল, তাদের হাতিয়ার মন্দিরা,মৃদঙ্গ, জয়পতাকা আর কণ্ঠে সুমধুর সংগীত,কীর্তনগান—"তুয়া চরণে মন লাগহুরে৷"এই নগর সংকীর্তনে নেতৃত্ব দিলেন অদ্বৈত আচার্য,হরিদাস এবং শ্রীবাস ৷ বিরাট মিছিল কণ্ঠে গান নিয়ে কাজীর গৃহদ্বারে উপনীত হলেন ৷ কাজী নতিস্বীকার করল ৷ জনগণের জয় হল ৷


নামকীর্তন বা নামজপ শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তন করেন বাচক জপ ও মানসিক জপ হিসাবে ৷

"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ৷ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥"

একক বা সমবেতভাবে উচ্চৈঃস্বরে বা মনে মনে এই গাওয়াই নাম গান বা নাম জপ ৷

কালভেদে বিভিন্ন সুরে এই গান গাওয়া হয় ৷


কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য-চরিতামৃত গ্রন্থে মধ্যলীলার দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদে কৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্য প্রদর্শিত চৌষট্রি অঙ্গের সাধন ভক্তির উল্লেখ করেছেন ৷ এই চৌষট্রি অঙ্গ সাধনভক্তির মধ্যে আবার-সাধু সঙ্গ, নামকীর্তন,ভাগবত শ্রবণ, মথুরাবাস ও শ্রীমূর্তি সেবন-এই পাঁচ অঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব আবার এই পাঁচ অঙ্গের মধ্যে "নাম-সংকীর্তন"ই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ৷ শ্রীচৈতন্যদেবের মতে *"নববিধা ভক্তিপূর্ণ হয় নাম হৈতে॥"*


শ্রীচৈতন্যদেব নাম সংকীর্তনকেই কলিযুগের পরম উপায় ও কৃষ্ণ আরাধনার যজ্ঞ বলে অভিহিত করেছেন—

*"নাম সংকীর্তন কলৌ পরম উপায় ॥*

*সংকীর্তন যজ্ঞে করে কৃষ্ণ আরাধন ৷ সেই ত সুমেধা পায় কৃষ্ণের চরণ॥* (৩/২০/৭-৮)

কৃষ্ণদাস কবিরাজের এই পয়ারের সাথে ভাগবতের "কৃষ্ণ বর্ণং ত্বিষা কৃষ্ণং" শ্লোকের সুস্পষ্ট ছায়াপাত আছে ৷ শুধু তাই নয় এই কলিযুগের যজ্ঞস্বরূপ নাম সংকীর্তনে সুবিধাও আছে ৷ শ্রীচৈতন্যদেবের মতে—

*"খাইতে শুইতে যথা তথা নাম লয় ৷ দেশ কাল নিয়ম নাই সর্বসিদ্ধি হয় ॥"* (চৈ:চ:-৩/২০/১৪)



এইখানেই মহাপ্রভুর ধর্ম সংস্কারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব-ধর্ম্মের সরলীকরণ ও গণতন্ত্রীকরণ ৷ ধর্ম সাধনার উপবাস,কৃচ্ছসাধনা,বহিরঙ্গের উপাচার-কোন কিছুর প্রয়োজন নাই ৷ জাতি-ধর্মনির্বিশেষে যে কোন মানুষ,যে কোন স্থানে, যে কোন অবস্থায়-যে সাধনা করতে পারে তা হ'ল নামকীর্তন ৷ বাংলার কীর্তনগানকে এইভাবে বাংলার কীর্তনকে নবজীবন দান করলেন ৷ *"বাংলার কী্র্তনগানের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যদেবের এটিই বড় অবদান"৷*


শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনাশ্রিত গৌরচন্দ্রিকা পদ রচনা বা নরোত্তম দাসের নেতৃত্বে খেতুরীর মহোৎসবে কীর্তনগানের সুর ও গায়ন ভিত্তিক নানা ঘরানার সৃষ্টি-এ সব তো পরের কথা ৷ ***বাংলার কীর্তনগানকে জনসাধারণের সামগ্রী করে তোলার কৃতিত্ব প্রধানতঃ শ্রীচৈতন্যদেবের ৷***

"ক্রমশঃ"

*"জয় মহাপ্রভু ৷"*

 
 
 

********#প্রবন্ধ******** ^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^❤ #বঙ্গে_নবজাগরণের_নায়ক_চৈতন্যদেব *❤️ ~~~ ~~"(#পর্ব_০১)"~~~~~~

"সম্পাদনা;-সনৎমিত্রঠাকুর !"

~~~~~~~


*** "'#ঊনিশ_শতকের পাশ্চাত্যমুখী নব—জাগরণ শুধু শিক্ষিত বাঙালী ও শহরকেন্দ্রিক ছিল ; অার চৈতন্যযুগের চৈতন্যময় অান্দোলন অাপামর বাঙালীজনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত সর্বাত্মক বৈপ্লবিক চেতনার প্রথম এবং সার্থক উন্মেষ ৷ ইতিহাস বলছে , বাঙালী চিত্তের বহু বহু শতাব্দী ধ'রে সঞ্চিত ক্লেদকলুষকে হরিচরণাশ্রিত প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অমিত সুদর্শনতনু ও বিশাল পুরুষাকারসম্পন্ন এই জনগণমন-অধিনায়কের বিপ্লব ৷ বাংলার প্রথম এই রুদ্রসম—তেজস্বী মহাবিদ্রোহীর কণ্ঠেই সার্থক উদ্ গীত হয়ে উঠেছিল যুগ যুগ ব্যাপী লাঞ্ছিত, নিপিড়ীত ও অবহেলিত মানবাত্মার প্রতিবাদের ভাষা—নাম—সংকীর্তন ৷ কায়েমি_স্বার্থ—সর্বস্ব বিরুদ্ধবাদীদের সকল অাপত্তির কোলাহলকে ছাপিয়ে , অত্যাচারী শাসকের সকল নিষেধাজ্ঞাকে স্তম্ভিত ক'রে, অাকাশ—বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল বাংলায় প্রথম এই সার্থক সাম্যের গান"'*৷



"'#ইতিহাস_স্বীকার করেছে , তথাকথিত বাঙালী জাতিকে অধঃপাতে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য যেমন "কোমলে কোমল ও কঠোরে কঠোর" এক মহামানবের প্রয়োজন ছিল , অভাবিত ভাবেই , তেমনই এক কল্পনাতীত মহামানবিক সত্তা নিয়েই অাবির্ভূত হয়েছিলেন এই প্রথম সমাজ—সংস্কারক ৷

ঐতিহাসিকের মূল্যায়ন—ব্রাহ্মণকুলজাত এই অসীম—বিক্রমী যোদ্ধার কল্যাণেই বাঙালী জাতি সেদিন সর্বাত্মক অবক্ষয়ের অাক্রমণকে প্রতিহত করতে পেরেছিলই শুধু নয় , অরক্তক্ষয়ী সংগ্রামে সামুহিকভাবে বিজয়ীও হয়েছিল৷

ইতিহাসের চুড়ান্ত সমীক্ষা—"শ্রীচৈতন্যের সমাজদর্শন বা পলিটিক্যাল ফিলসফি তাঁর প্রায় সমসাময়িক খ্রিষ্টীয় অান্দোলনের (মার্টিন লুথার) কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ মনে_করিয়ে দেয় বামপন্হার অারেক পুরোধা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের মন্তব্য....মহামতি মার্কস তো সরাসরি শ্রীচৈতন্যের গণ অান্দোলন (তথা শ্রেণীযুদ্ধ)—কে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন , জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রামী উদারনীতির প্রবক্তা শ্রীচৈতন্য একজন সাচ্চা রিফরমার ৷



'#শ্রীচৈতন্যের_বৈষ্ণব অান্দোলনে যেমন অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হয়েছে , তেমনই নারী জাতিকে দেওয়া হয়েছে এক বিশেষ সস্মান ৷ এই অধিকারে হঠাৎ করেই স্ত্রীজাতির সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষার পথ খুলে গিয়েছিল ৷

"'মহাত্মা_গান্ধীর সত্যাগ্রহের শিক্ষা শ্রীচৈতন্যের অহিংস—পন্হায় শত্রুবিজয়ের ফসল ....স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে শ্রীচৈতন্যেরই প্রতিধ্বনি—'নীচজাতি , মূর্খ , দরিদ্র , অজ্ঞ , মুচি , মেথর , তোমার রক্ত , তোমার ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি"'*৷

শ্রীচৈতন্য_মহাপ্রভু, এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব,তাঁর নামানুসারে বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যযুগ নামে এক নবজাগরণের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা, তা-ই সমগ্র বাংলার মানুষকে অাকৃষ্ট করেছে চৈতন্যমহাপ্রভুর জীবন-দর্শন উপলব্ধি করার অভিলাষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ বাংলা ভাষাকে অায়ত্ব করেছে ৷



#কবি_নজরুল_ইসলাম শ্রীচৈতন্যদেবের গুণ গেয়ে বলেছেন—

"বর্ণচোরা ঠাকুর এ রসের নদীয়ায়, তোরা দেখবি যদি অায় অাবার কেউ বলে তায় গৌরহরি, কেউ অবতার বলে তায় ॥

কবি_সত্যেন্দ্রনাথ_দত্ত তার "অামরা" কবিতায়—

"ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া ৷ বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া ॥

বাঙালির অমৃতময় হৃদয় হরণ করে যে কায়া ধারণ করেছে, তা হলো নিমাই, যার হৃদয় কমলের চেয়েও কোমল ৷

বিশ্বকবি_রবীন্দ্রনাথ_ঠাকুর

বলেন—"অামাদের বাঙালির মধ্য থেকেই তো চৈতন্য জন্মেছিলেন, তিনি তো বিঘা-কাঠার মধ্যে বাস করতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে অাপনার করে নিয়ে ছিলেন, তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করে তুলে ছিলেন ৷"***


***#চৈতন্যসম্ভব_এর_কথায়--চৈতন্যের মধ্যে বিপ্লবী খুঁজে পায় জনঅান্দোলনের জয়ধ্বনি অার রক্ষণশীল খুঁজে পায় অাধ্যাত্মিকতার সর্ব্বোচ্চ শিখর ৷ নাস্তিক এই অান্দোলনে মানব অস্তিত্বের অবলম্বন খুঁজে পায় অার অাস্তিক এই অান্দোলনে পায় ঈশ্বরের বিভূতি৷ একাধিক কমুনিষ্ট নেতা চৈতন্যদেবের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন গৌড়বঙ্গের প্রথম কমিউনিষ্ট, অার গান্ধি স্বয়ং খুঁজে পেয়েছিলেন মধ্যযুগের প্রথম অহিংস অান্দোলনের নজির ৷ চৈতন্যস্মরণে রত হন যুক্তিবাদী থেকে ভাববাদী, পণ্ডিত থেকে অজ্ঞ ৷ তাঁর নামে গৌরাঙ্গ বলে উদ্বাহু তুলে প্রায় সকলে নৃত্য করেছে ৷ ব্রাহ্মণ অার অার চণ্ডাল এই চৈতন্যদেবের অান্দোলনে পরস্পরের হাত ধরে নৃত্য করেছ ৷ চৈতন্যদেবর নামে এই অান্দোলনে কবির সঙ্গে অকবির অাঁতাত হয়, কেজোর সঙ্গে অকেজোর মিত্রতা হয় ৷ এই অান্দোলন সমস্ত গৌড়বঙ্গীয়ের মহামিলনমেলা ৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির অভিজ্ঞান ৷



#যে_নবদ্বীপে চৈতন্যদেব অবতীর্ণ, সে নবদ্বীপ তখন ভারত শ্রেষ্ঠ, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার স্বত পীঠস্থান ৷ জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনচর্চায় নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য ছিল ৷ মধ্যেযুগের অন্ধকারে নবদ্বীপের এই সুতীব্র অালোকচ্ছটাকে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির প্রথম রেনেসাঁস অাখ্যা দিয়েছিলেন ৷ অামাদিগেরও একবার সেদিন হয়েছিল ৷ অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয় ; তারপর রূপ-সনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি ধর্ম্মতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত ৷ এদিকে দর্শনে রঘুনাথ শিরোমণি, গদাধর, জগদ্বীশ ;স্মৃতিতে রঘুনন্দন এবং তৎপরগামিগণ ৷ অাবার বাংলা কাব্যের জলোচ্ছ্বাস ৷ বিদ্যাপতি, চণ্ডিদাস, চৈতন্যদেবের পূর্বগামী , কিন্তু তারপরে চৈতন্যদেবের পরবর্ত্তিনী যে বাংলা কৃষ্ণবিষয়িণী কবিতা, তা অপরিমেয় তেজস্বিনী, জগতে অতুলনীয়া; সে কোথা হতে ? অামাদের রেনেসাঁস কোথা হতে ?

কোথা হতে সহসা এই জাতির অই মানসিক উদ্দীপ্তি হল ?


সেযুগের_ভারতে সার্বভৌম বোধকরি শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত-দার্শনিক-নৈয়ানিক, পরে তিনি পুরীতে চলে যান ৷ এবং নীলাচলেও মহাপ্রভুর (চৈতন্যদেবের) অাগমনের জমি প্রস্তুত হয় ৷ চৈতন্যদেবের অান্দোলন পাণ্ডিত্বের বিরোধী নয়, কিন্তু অবভাস প্রশ্রয় দেয় না ৷ চৈতন্যদেবের ভক্তি অান্দোলন ঋজু ও স্পষ্টবক্তা, সেজন্য নব্যন্যায়ের দাঁতভাঙা পাণ্ডিত্যকে পাষণ্ডী অাখ্যা দেওয়া হয়, চৈতন্যদেবের অান্দোলন জ্ঞানমার্গের বিরোধী নয়, তবে সহজিয়া লোকায়ত চেতনা বরাবরই জ্ঞানমার্গের নামে অবভাসের যথেচ্ছাচারের বিরোধী ৷ কারণ চৈতন্যদেবের উথ্বান বাঙালির মধ্যযুগের প্রথম জনঅান্দোলন , অার অবভাসের প্রধান উদ্দেশ্য গণমানুষকে বিভ্রান্ত করা ৷



#চৈতন্যদেবের অান্দোলন *বনমালীর পরজন্মের রাধা* হওয়ার অান্দোলনও বটে ৷ সেজন্য এই অান্দোলন পুরুষতান্ত্রিকতাকে সমূলে অাঘাত করে ৷ সহজিয়া সাম্যের চেতনা শুধু তাত্ত্বিক স্তরে নয়, ব্যবহারিক স্তরেও ছিল ৷ অসংখ্য নারী, অসংখ্য অব্রাহ্মণ গুরুপদে অাসীন হয়েছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব অান্দোলনে, এই অান্দোলনের মধ্যে স্থানে স্থানে ব্রাহ্মন্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক ঝোঁক সত্ত্বেও ৷ মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে প্রচলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী চৈতন্যদেবের চারশত নব্বই জন পরিকরের মধ্যে দুইশত উনচল্লিশ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ, সাঁইত্রিশ জন বৈদ্য(ঈশ্বরপুরী, চৈতন্যদেবের প্রথম জীবনীকার মুরারীগুপ্ত, দু'জনেই বৈদ্য) উনত্রিশজন কায়স্থ, ষোলজন স্ত্রীলোক, ও দু'জন মুসলমান ৷ অর্ধেকের বেশি অব্রাহ্মণ ৷ নিত্যানন্দপ্রভুর সময় হতে সহজিয়ারা বৈষ্ণব অান্দোলনের অংশীদার হয়েছিলেন, তাঁদেরকেই জাত বোষ্টম বলা হয়, কারণ তাঁরা সহজিয়া ছিলেন বলে জাতপাত মানতেন না, ফলে জাতপরিচয় ছল না ৷ এই কথা অনস্বীকার্য যে সমাজে যাঁরা অাউটকাস্ট,তাঁদের দৃঢ়ভাবে একসূত্রে গ্রন্থিত করেছল বৈষ্ণব ভক্তি অান্দোলন ৷


#বৈষ্ণব_অান্দোলন প্রায়শ অাউটকাষ্টদের ক্ষমতায়ন, ক্ষতবিক্ষত মানুষদের শুশ্রূষালয়,

অাহত মানবসত্তার বাস্তব অাশ্রয় ৷ সেটাই অবশ্য ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, মার্ক্সের ভাষায়ঃ অাত্মাহীন জগতের অাত্মা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, জনতার ওষুধ ৷ ঐহিক অাবিলতা থেকে উত্তরণ চাইছিলেন যারা, যাঁরা অন্যরকম মানুষ, যাঁরা বিপ্লবী,ভূতগ্রস্ত, তাঁদের অনক দীর্ঘশ্বাস মন্থন করে এই চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল ৷


#বাঙালির_হিয়া_অমিয়_মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া," সত্যেন দত্ত যথার্থই বলেছেন ৷ তবে বাঙালির অসীম বেদনা মন্থন করেও চৈতন্যসম্ভব ঘটছিল ৷ অার্যাবর্তের হাতে অাক্রান্ত, ইসলামের হাতে অাক্রান্ত, পরুষতান্ত্রিকতার হাতে অাক্রান্ত, বিস্মৃতির হাতে অাক্রান্ত, নালন্দা বিক্রমশীলা পুড়ে যাওয়ার অাগুনে অাক্রান্ত, মধ্যযুগের অনিবার্য মহাঝঞ্ঝায় অাক্রান্ত বাঙালির বেদনা, বাঙালির ক্রমশঃ কোনঠাসা হয়ে যাওয়ার বেদনা, এঅভাবে অনেক বেদনার বারুদ ঐকসঙ্গে জমে চৈতন্য বিস্ফোরণ ঘটেছিল ৷



*#সাংখ্য_অাশ্রিত_গীতার সেই শ্লোক বারবার স্মরণ করি—


"'যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ৷ অভ্যুথ্বানম্ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ৷ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥"'


***#চৈতন্যদেবের_সমাজের অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে কর্মকাণ্ডের কথা জানা যায়;-অসত্য,অন্যায় সমাজে পরিব্যপ্ত হলে সমাজের বাহ্যিক ক্ষেত্রে তার শোধন বা পরিবর্ত্তন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে ৷

কিন্তু মানুষ নিয়েই তো সমাজ ৷ সেই মানুষের অন্তর যদি কলুষিতই থাকে,তাহলে অসত্য- অন্যায়ের প্রতি তার সহজ টান কেউ অাটকাতে পারে না ৷ অার অসত্য অন্যায়ের সংসর্গে তার দ্বারা সমাজও কলষিত হয় ৷ যুগ যুগ ধরে মানব অতহাস এই তথ্যই দিচ্ছে ৷ তবে এই ইতিহাসের সঙ্গ পারম্পর্য রক্ষা করে অারেকট তথ্যপূর্ণ ইতহাস চল অাসছে ৷ যখনই সামাজিক গ্লানি পূর্ণমাত্রায় দেখা দিয়েছে,তখনই কোন না কোন সুনির্দিষ্ট কিংবা অারও একটু গভীরভাবে বলল সচিহ্নিত মানুষ নজের জীবন উসসর্গ করে সমষ্টি-জীন নিষ্কলুষ করবার সাধনায় মেতে উঠেছেন ৷ তখন, তাঁদেরই হাত ধরে সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছুটে এসেছে নবজাগরণ (রেনেসাঁ)৷ সমষ্টির কাছে তাঁরা হয়ে উঠেছন সমাজ সংস্কারক, কোন কোনও ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী মহামানব ৷ যে মহামানব জন-মানসকে যত বেশী পরিমাণে সুপ্রভাবিত করে জন-জীবন-শৈলী পবিত্রতর করতে পেরেছেন,তিনি মানুষের মাঝে, মানুষের কাছে তত বড় মহামানব, অতিমানব, অতিমানব কিংবা লোকোত্তরমানবরূপে রূপায়িত হয়েছেন ৷


*#সমাজ_সংশোধনের এই প্রক্রিয়া দুই ধারায় প্রবহমান হয় ৷ *এক বাহ্যিক ধারা ৷ *দুই অভ্যন্তরিণ ধারা ৷ সমাজের যেখানে যেখানে কলুষতা, গ্লানি বা দুর্নীতি, সেখানে সেখানে উপযুক্ত সংশোধনাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সমাজ গ্লানি মুক্ত করার প্রক্রিয়া হল প্রথম পর্য্যায়ের, এ কাজ প্রধানতঃ এবং প্রথাগতভাবে রাজা, রাজকর্মচারী অথবা রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিগণেরই করণীয় ৷ কিন্তু তাঁরাও তো মানুষ তার উর্দ্ধে কিছু নন , তাই তাঁদেরকে নিয়ে সমাজের গ্লানি অপসারণে তখন পূর্ণ ভূমিকায় প্রকটিত হন সার্থক সমাজ সংস্কারক ৷ এ গেল বাহ্যিক ক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তন ৷ এক্ষেত্রে অাইনী বা শাস্তির ভয়ে অাপাতত সংশোধিত বা পরিবর্ত্তিত মানুষজন অাবারও কলুষতানুকুল পরিস্থিতির ব্যবহারে এবং অাপন স্বভাবজাত কারণে দুর্নীতি পরায়ণ হতে পারেন ৷ বাহ্যিক সমাজ সংশোধনের প্রাঙ্গনে এই এক বিরাট ফাঁক বা ত্রুটি ৷ তাই সমাজবিজ্ঞানীগণের চিন্তাভাবনায় এই প্রক্রিয়া সার্ব্বিক বা সর্ব্বাত্মক নয় ৷



*#এবার_সমাজের_অভ্যন্তরিণ

ক্ষেত্রের পরিবর্ত্তনর কথায় অাসা যাক:-মানুষ দুর্ব্বার কুবাসনা স্বার্থন্ধতায় মোহগ্রস্ত হয়েই দুর্নীতির অাশ্রয় নেয় ৷ দুর্ব্বাসনা বা স্বার্থসিদ্ধি বাসনা জাগে তার মনে ৷ তারই বহিঃপ্রকাশ ঘট তার দুষ্ককর্মের মধ্য দিয়ে সমাজের নানান ক্ষেত্রে ৷ অতএব বিষয়টি মানসিক,মন অন্তরেন্দ্রিয় ৷ তাই বিষয়টিকে অান্তরিক বা অভ্যন্তরিন বিষয়ও বলা যেতে পারে ৷সুনির্দিষ্ট বা সুচিহ্নিত সেই বিশেষ মানব তখন মানব মনকে বুঝতে পারে এবং কলুষমুক্ত করার প্রজত্নে যত্নশল হন ৷ সত্য,ন্যায়,শুভ, মঙ্গলময়ী কামনা নিয়ে পরম-প্রেম পূর্ণ ব্যবহারে মানুষের কাছে গিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করবার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ৷ তাঁর প্রীতিতে,মাধূর্য্যে,সহজ-সরল মানবীয় ব্যবহারে মানব মন অালোড়িত হয় ৷ স্বাভাবিকভাবেই

কলুষিত চিত্তবৃত্তি হেতু স্বার্থসিদ্ধিতে মস্তবড় প্রতিবন্ধকতা রচিত হয়,তখন এক শ্রেনীর কাম প্রতিহত হলে ক্রোধ উৎপন্ন হয় ৷অার সেই ক্রোধ পুঞ্জীভুত হয়ে সুচিহ্নিত মহামানবের শরীরে অাঘাত হানে ৷ মানব ইতিহাসে এ বড় কালিমালিপ্ত এবং বেদনাদায়ক অধ্যায় ৷ কিন্তু মহামানব তো মানব দরদের মূর্ত্ত বিগ্রহ ৷ মানব কল্যাণার্থে তাঁর জীবন তো উৎসর্গৃকৃত ৷ তাই এই জাতীয় অাঘাত বা রক্তপাতে মহামানবের অভিযান স্তব্ধীভূত হয় না ৷ বরঞ্চ অারও বলবতী ও বলীয়সী হয় ৷ তখন ক্রমে ক্রেমে অাঘাতকারী-দেরও মন প্রাণ গলতে থাকে ৷ তাঁদের মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে , যার ফলস্বরূপ তাঁদের মনে জাগে অনুশোচনা ৷ অনুশোচনার অঙ্গারে জ্বলতে থাকা হৃদয় জুড়ানোর রাস্তা তাঁরা খুঁজতে থাকে ৷ মহামানবের পরশে ক্রমে নমনীয় হতে থাকে তাঁরা ৷ নিজিকে সোঁপে দেন মহামানবের কাছে ৷ একসময় তাঁদের তথা সমাজের প্রতিটি মানুষের মনে-প্রাণে মানবীয় গুণের ছোঁয়া লাগে ৷ পরশমণির পরশে লোহা যমন সোনাতে পরিণত হয় তদ্রুপ মহামানব-পরশমণির সংসর্গে কলুষিত মানব মন বিজ্ঞানসম্মতভাবে ধীরে ধীরে সবার অলক্ষে প্রকৃত মানবত্বগুণে সোনাতে রূপান্তরিত হয় ৷ সময়ান্তরে মানব মনে পূর্ণ মানবত্ব জাগ্রত হয় ৷ মহামানবের কাজ কিন্তু চলতেই থাকে ৷ সেই মহামানব এরপর জীবপ্রীতি বা মানবপ্রীতির মনস্তাত্বিক অালম্বন অর্থাৎ ঈশ্বর প্রীতির সঙ্গে মানব মনকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন ৷ সমর্পিত প্রাণ পেয়ে এই অতিমানবীয় কাজটি তিনি সুসম্পন্ন করতে থাকেন ৷ স্বাভাবিকভাবেই তিনি কৃতকার্য্য হন ৷ সমাজ তখন দেবতুল্য মানবে সুশোভিত হয় ৷ অার মানুষের অন্তর কলুষ মুক্ত হয়ে গেলে অাপনা হতেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে নিষ্কলুষতা প্রতিভাত হয় ৷ সামগ্রিক বা সর্বাত্মকভাবে তখনই সমাজ সংশোধিত, কলুষমুক্ত বা গ্লানিশূন্য হয় ৷ শুধুমাত্র বাস্তব বোধ দিয়ে কোন কালে,কোন যুগে এই অত্যাশ্চর্য্য কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয় নি ৷ গঢ়ভাবে তাকালে দেখত পাব, এটা সম্ভব হয়েছে মানবের মন দিয়ে ভাব রাজ্যে প্রবেশ করে তা বিলোড়িত করতে পারলেই ৷



*#ইতিহাস_বলছে, সর্বস্তরের মানব মনের অভ্যন্তর স্থিত ভাব রাজ্যে অালোড়ন তুলেছিলেন যে মহামানব, অাতিমানব বা লোকোত্তর মানব তিনি চৈতন্যদেব ৷ তাই তাঁর এই অান্দোলনকে বলা হয় ভাবান্দোলন ৷ ভাব দিয়ে ভাবরাজ্যে প্রবেশ করে ভাব সমুদ্রে ঢেউ তোলা ৷ এ অতি অসাধারণ কাজ ৷ অার অতি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছাড়া এই অতি অসাধারণ কাজ অসম্ভব ৷ তাই ঐতিহাসিক তথ্যের থেকেও গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যে,ইতিহাসে এবং দর্শনে মূলতঃ স্থান পেয়েছে ভাবের কথা বা ভাবলোচনা ৷ সর্বত্রই ভাবের ছড়াছড়ি ৷ এই ভাবের সামর্থ্যে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নাই ৷ তার কারণ, একমাত্র ভাবই পেয়েছে অাজ থেকে পাঁচ শতাব্দী অাগে কল্মষক্লিষ্ট মানুষকে, শুধু মানুষই নয় সস্মাননীয় বৈষ্ণবাচার্য্যে রূপান্তরিত করতে ৷ যার ব্যপ্তি ঘটেছিল সমগ্র বঙ্গে তথা ভারতবর্ষে ৷ অার এখন ঘটছে সমগ্র বিশ্ব ৷ নিরন্তর তার ব্যপ্তি ঘটে চলেছে ৷ (তখন তার উদাহরণ ছিল,জগাই-মাধাই, মলয় চাঁদ কাজী, ডাকাত,উগ্রক্ষত্রিয়, বীরহাম্বির সিং,ইত্যাদি ইত্যাদি, এখন পর্যন্ত অগণিত,অসংখ্য ভবিষ্যতে অারও,অারও )৷


#চৈতন্যদেবের_বৈষ্ণব অান্দোলন সম্বন্ধে জানা যায়:-বৈষ্ণব অান্দোলন চৈতন্যদেব(১৪৮৬-১৫৩৩) প্রবর্তিত ধর্মীয় ও সামাজিক অান্দোলন, যা ভক্তি অান্দোলন নামেও পরিচিত ৷ তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নদীয়ায় এ অান্দোলন গড়ে ওঠে ৷

বৈষ্ণব অান্দোলনের সূত্রপাত মূলত শুরু হয় চৈতন্যদেবের পূর্বে চণ্ডীদাস(১৪শ শতক) ও বিদ্যাপতির(অানুমানিক ১৩৭৪-১৪৬০)বৈষ্ণবপদ রচনার মধ্য দিয়ে; চৈতন্যদেব এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে এটি একটি সামাজিক অান্দোলনে পরিণত হয় ৷ তখন এর নতুন নাম হয় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম,যা সাধারণভাবে বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত ৷ হিন্দু সমাজে ভগবৎপ্রেম ও ভক্তিবাদ অাশ্রিত বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান থাকলেও সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির অাদর্শ যুক্ত করে চৈতন্যদেব একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন ৷ তিনি রাধা-কৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্বকে গ্রহণ করে অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদের কথা বলেন ৷ কৃষ্ণের হ্লাদিনী বা অানন্দদায়িনী শক্তির মানবীরূপ হচ্ছে রাধা ৷ সুতরাং মূলে উভয়ে অদ্বৈত,কিন্তু দেহরূপে দ্বৈত; পুনরায় অদ্বৈত বা একাত্ম হওয়ার জন্যই তাঁরা মর্ত্যলীলা করেন ৷ প্রেম ও ভক্তি দিয়ে পরমাত্মাকে পাওয়া যায়; তাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায় ৷ রাধাকৃষ্ণের প্রেমসাধনা একাত্ম হওয়ার সাধনা ৷ এজন্য তা 'দ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্ব' নামে পরিচিত ৷ এ তত্ত্বের উপলব্ধি ও সাধনা সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য নয় বলে একে 'অচিন্ত্য' বলা হয়েছে ৷***



*#গৌড়ীয়বৈষ্ণব_ও_পূর্বেরবৈষ্ণব

ধর্মের পার্থক্য;-(১) গৌড়ীয়-বৈষ্ণবধর্মে রাধাকৃষ্ণই মূল, কিন্তু পূর্বের বৈষ্ণবধর্মে বিষ্ণুকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ৷ চৈতন্য অাবির্ভাবের অাগেও কিছু ভক্তকবি রাধাকৃষ্ণ লীলা রচনা করেছিলেন, তবে তা সীমাবদ্ধ ছিল ৷ (২)গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু হিসেবে শ্রীচৈতন্যদেবের ভজন করা হয়, অাগে যা ছিল না ৷ (৩) গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের মূল হল সংকীর্তন, যা অাগের তুলনায় অালাদা ৷


*#বৈষ্ণবধর্মে_কীর্তন_প্রচলিত ছিল,চৈতন্যদেব পদযাত্রাসহ নামসংকীর্তন ও নগরকীর্তন প্রবর্তন করে এতে নতুনমাত্রা যোগ করেন ৷ ভক্তিভাবাশ্রিত নামসংকীর্তনে বৈষ্ণব অান্দোলন প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয় ৷ এ কারণে বৈষ্ণব অান্দোলন 'ভক্তি অান্দোলন' নামেও অভিহিত হয় ৷ অাবার সার্বিকভাবে চৈতন্যদেবের অবদানের কথা স্মরণ করে একে 'চৈতন্য অান্দোলন'ও বলা হয় ৷ চৈতন্যদেবের এই অান্দোলনের প্রধান কারণ দু'টি; এক-স্বধর্ম ও স্বসমাজের সংস্কার সাধন এবং দুই-শাসক শ্রেণির ছত্রছায়ায় ইসলাম ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করা ৷ চৈতন্যদেব এক দিক বিরাজমান হিন্দু অভিজাতদের ম্লেচ্ছাচার রোধ করেন, অপরদিকে নামসংকীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে নব্য প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন ৷ এভাবে চৈতন্যদেব উচ্চ ও নিম্ন বর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরর কাছে এনে এক অাত্মীয়ভাবাপন্ন হিন্দু সমাজ গড়ে তুলত চেয়ে ছিলেন ৷


*#চৈতন্যদেবের_সময়ে_হিন্দু সমাজের অবস্থা ছিল খুবই সঙ্কটজনক,সমাজে তখন বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কারণে অস্পৃশ্যতা, অস্পৃশ্যতার কারণে বৈষম্য এবং বৈষম্যের কারণে সামাজিক অনৈক্য বিরাজ করছিল ৷ উপরন্তু সতী প্রথা, কৌলীন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, জাতিচ্যুতি, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি সংস্কার হিন্দু সমাজকে নানাদিক থেকে অাড়ষ্ট করে রেখেছিল ৷ চৈতন্যদেব হিন্দু সমাজের এই অচলায়তন ভেঙে তাতে মানবতার নবপ্রাণ সঞ্চার করেন ৷

চৈতন্যদেবের কাছে কোনও জাতিভেদ,ধর্মভেদ,বা বর্ণভেদ ছিল না ৷ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রচার করেন, কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে কোনও জাতিকুল বিচার নেই, সবাই সমান ৷ বৈষ্ণব অান্দোলনের মূল শক্তি এখানেই নিহিত ৷



*#মধ্যযুগে_বিভিন্ন_বর্ণশ্রেণীতে বিভক্ত হিন্দু সমাজে চৈতন্যদেবের এই মতবাদ ছিল কল্পনাতীত ৷ তখন সমাজের উচ্চে ছিল ব্রাহ্মণ, অার নিম্নে ছিল শূদ্র ৷ ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের সামাজিক সংস্কারের অধিকারে অাকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল ৷ তুর্কি বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কঠোরতা অারও বৃদ্ধি পায় ,এরূপ অবস্থায় ব্রাহ্মণ সন্তান চৈতন্যদেব- চণ্ডাল,মুচি, ম্লেচ্ছ,বৈশ্য,কায়স্থ,ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের মানুষকে কৃষ্ণের প্রেমমন্ত্রে ডাক দিয়ে ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেন ৷ চৈতন্যদেব নিজে চর্চা করে অন্যকে শিক্ষা দিতেন ৷ চৈতন্যদেব জাতিভেদের কঠোরতা শিথিল করেন ৷ চৈতন্যদেবের কাছে শাস্ত্রের চেয়ে মানুষের জীবনর মূল্য ছিল অধিক ৷ চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিবাদে সমাজের সব স্তরের মানুষের সমাবশ ঘটছল ৷ এতে সামাজিক সচলতার লক্ষণ প্রকাশ পায় ৷ সেকালর বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবরা এ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক চেতনার পরিচয় দেন ৷


*#শীর্ষস্থানীয়_বৈষ্ণব_গুরুদের মধ্যে নারীরও স্থান ছিল, নিত্যানন্দপ্রভুর পত্নী ও বীরভদ্রের বিমাতা জাহ্নবীদেবী বৈষ্ণব কেন্দ্র গড়ে তুলে ধর্ম প্রচার করেন, জাহ্নবীদেবী ভক্তদের চোখে 'ঈশ্বরী' রূপে খ্যাত ছিলেন ৷ খেতুরী উৎসবেও জাহ্নবীদেবী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন ৷বিষ্ণুপুরের শ্রীনিবাস অাচার্যের কন্যা হেমলতা ঠাকুরানিও অনুরূপভাবে অাখরা পরিচালনা করেন, নাথপন্থায় মহাজ্ঞানের অধিকারিণী ময়নামতীও গুরুর অধিকার পান ৷ ধর্মপ্রচারে নারী ও পুরূষকে সমান অধিকার দিয়ে বৈষ্ণবগণ প্রগতিশীল সাংগঠনিক চেতনার পরিচয় দেন ৷


*#চৈতন্যদেবের ১৪৮৬-১৫৩৩ প্রভাবকাল মধ্যযুগের বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের এক গৌরবময় ইতিহাস ৷ চৈতন্যদেবের যুগান্তকারী অাবির্ভাবের ফলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল,তা সুনিশ্চিতভাবেই সাহিত্যর গতিপথকেও প্রভাবিত করে ৷ প্রতিষ্ঠাপর্ব বাঙালি সংস্কৃতির দু'টি ধারার যে মিলন ঘটেছিল, এখানে তা কোমল ও ললিত ভাবধারায় সঞ্জীবিত হয় ৷ প্রেম ও ভক্তির ভাবরসপ্রবাহে বাঙালি নিজের মুক্তিমন্ত্র শুনতে পায় ৷ অন্যদিকে, রাজশক্তি হারিয়ে বাঙালি যে হীনমন্যতায় ভুগছিল, সে অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলেও,ভাবের দিক থেকে চৈতন্যদেব বাঙালিকে উদ্ধার করেন ৷ অার এই কারণেই চৈতন্যদেব প্রবর্তিত এই ধর্ম অান্দোলন একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অান্দোলনও বটে ৷ এই অান্দোলনের ফলে বাঙালি জাতি তার অাত্মসস্মান ফিরে পায় ৷ পরাজিতের মনোভাব থেকে মুক্তি অার চিত্তের গভীর ভাব প্রবণতায় নতুন মূল্যবোধের অনুসন্ধান বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে ৷ রচনার প্রাচুর্য ও উৎকর্ষে বাংলা সাহিত্যের নব নব দিগন্ত উন্মোচিত হয় ৷ চৈতন্য সংস্কৃতি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে ভাব ও রূপের বিশেষ পরিবর্তন সাধন করেছিল ৷ এই পরিবর্তনের দু'টি প্রধান দিক-প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ৷ প্রত্যক্ষ প্রভাবের অাবার দু'টি দিক- বৈষ্ণব পদাবলীর গৌরচন্দ্রিকা ও গৌরপদাবলী ধারা এবং চৈতন্যজীবনী সাহিত্য ৷ চৈতন্য সংস্কৃতির পরোক্ষ প্রভাব দেখা যায়-চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ও ধর্মমঙ্গল ধারার মঙ্গলকাব্য, রামায়ণ,মহাভারত,ভাগবত অনুবাদ সাহিত্য,শাক্তপদাবলী ও লোকসাহিত্য ৷


*#চৈতন্যদেবের_অাবির্ভাবে_যে ভাববিপ্লব এসেছিল,তার গভীর ছাপ পড়েছিল বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে ৷ প্রাক চৈতন্যযুগে মানব-মানবীর পার্থিব প্রেমই ছিল রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলীর মূল ভিত্তি ৷ কিন্তু চৈতন্যদেবের অাবির্ভাবের পর পার্থিব মানব-মানবীর প্রেম পরিণত হয় অপার্থিব রাধাকৃষ্ণ লীলায় ৷ নব জন্মান্তর ঘটে সমগ্র পদাবলী সাহিত্যের ৷ শুধু তাই নয় 'গৌরচন্দ্র' অর্থাৎ স্বয়ং চৈতন্যদেব(মহাপ্রভু)কে নিয়েও রচিত হয় পদাবলীর দু'টি বিশেষ শাখা-'গৌরচন্দ্রিকা' ও 'গৌরপদাবলী' বা গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ৷ এই পদগুলি বৈষ্ণব সাহিত্যের নবতর সংযোজন ৷ তাই এককথায় চৈতন্যদেব প্রভাবে পদাবলী সাহিত্যে এক ব্যপকতর ও সূক্ষ্মতর পরিবর্তন দেখা যায় ৷ চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রত্যক্ষ ও সুপরিণত রূপ জীবনীসাহিত্যের মধ্যেই বিকশিত ৷ চৈতন্যদেবের দেবোপম চরিত্রকে ঘিরে বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম জীবনীসাহিত্য গড়ে ওঠে ৷ সূতরাং নবতর সংযোজনের পরিপেক্ষিতে এই সাহিত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম ৷ বৃন্দাবন দাস তাঁর 'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থের মাধ্যম এই নতুন পথের দ্বার উদ্ঘাটন করেন৷ পরবর্তীকালে কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' লোচনদাসের 'চৈতন্যমঙ্গল', জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল' প্রভৃতি চরিতসাহিত্যের এই শাখাটিকে সমৃদ্ধতর করে ৷ জীবনীসাহিত্যের এই উদ্বোধন পরবর্তীকালেও নব নব অাঙ্গিকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ৷



*#চৈতন্যযুগে_চৈতন্যদেবের অাচরিত প্রেমধর্ম ও চৈতন্যদেবের ত্যাগ-বৈরাগ্যপূত অাদর্শের দিব্যপ্রেরণা অাশ্চর্য শক্তিসঞ্চারে সমাজ মনে ও বহির্জীবনে স্বর্গ-মর্ত্যের ব্যাবধান ঘুচিয়ে বস্তু সমর্থনের অপূর্ব সুযোগ দিয়েছে ৷ ভাবজীবন ও কর্মজীবন দিব্যপ্রেমের প্রেরণাসাম্যে সমন্বয়ের অক্ষপথে একই লক্ষ্যবিন্দুকে প্রদক্ষিণ করেছে ৷ কি কাব্যের নন্দনকাননে, কীর্তনগীতির অমৃতনির্ঝরে, পূতচরিত কথায় মহিমার ক্ষেত্রে, লীলাস্মরনের অাধ্যাত্মিকতায়,দর্শনের প্রত্যয় প্রতিষ্ঠায়,ভাবসাধনার নিগূঢ় কল্পলোকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে চৈতন্যযুগে যে সুমহৎ প্রেরণার অভিব্যক্তি ঘটে, সত্যই তার তুলনা নাই ৷ চৈতন্যদেব(মহাপ্রভু)মাতৃভক্ত শিরোমণি ৷ তাঁর মাতৃভক্তি জীবের অাদর্শ-পরম শিক্ষার স্থল৷***


*** "'#কিন্তু_ইতিহাসের_বিচার তো অনেক পরের ব্যাপার ৷ ত্রেতাযুগের রঘুপতি বা দ্বাপরের যদুপতিকে নিয়ে ঐতিহাসিক অনুসিদ্ধান্তের সঙ্গে যেমন ভক্তহৃদয়ের বিশ্বাস মেলে না , ইতিহাসের মহাবিপ্লবী শ্রীচৈতন্য ও ভক্তহৃদয়ের পরমেশ্বর শ্রীচৈতন্যদেবেরও তেমনই পার্থক্য ৷ অথচ সত্যের নিরিখে দুটির কোনটিই উপেক্ষনীয় নয় ৷

বিশ্বাসেরও_বিশ্বাস্য ভিত্তি থাকে ৷ যেমন;— ভাগবতে বর্ণিত যশোদাদুলালের পৌরাণিক পৌরুষের কথা শুধুই শোনা গেছে বা পঠিত হয় ; কিন্তু ষোড়শ শতকের রূঢ় বাস্তবতায় শচীনন্দনের লীলা ও অবদান প্রত্যক্ষকারী মহাভাগ্যবান্ ব্যক্তিবর্গ সেই মুহূর্তে "' যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ৷ অভ্যুথ্বানধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ "' ॥ (#যখনই_ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুথ্বান হয় ,, সেই সময়েই অামি নিজেকে সাকাররূপে প্রকট করি দেহ ধারণ করি)—অঙ্গীকারের অমোঘত্ব নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতে ভুল করেন নি ৷


#অাসলে_অাজকের_মতো_এত বিচার—বিশ্লেষণের কোন প্রয়োজনই সেদিন হয়নি ৷ অাপন মনের উপলব্ধিজাত মন্ত্রকেই অভিজ্ঞতালব্ধ পরম বিশ্বাসে রূপান্তরিত করে নিয়েছিলেন তখনকার চৈতন্যভক্তগণ ৷ তাঁরা বিশ্বাস না করে পারতেন না—তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ , দ্বাপর যুগের কৃষ্ণের মতো তিনি কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন না , তিনি গৌরবর্ণ—গৌরাঙ্গ—গৌরহরি"'*যুগধর্ম_হরিণাম সংকীর্তনের মাধ্যমে তিনি ভগবৎপ্রেম প্রচার করেছেন এবং সুমেধাবান্ ব্যক্তিরা ভগবৎ—সাক্ষাৎ প্রাপ্তির এই সহজ পথ গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন"'*#ভক্তহৃদয়ে কোন সংশয়ই ছিল না—মৎস্য কূর্ম ইত্যাদি দশাবতারের যুগ অতিক্রান্তের পর সত্যই একদিন " একাদশতম" বিষ্ণু—অবতাররূপে এসেছিলেন এই নদের চাঁদ—ভারতপ্রদীপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব ৷



#বৈষ্ণব ও জাতবৈষ্ণব সম্বন্ধে

;— বাংলার ধর্মীয় জাতপাতের সংকটময় মুহূর্তে চৈতন্য মহাপ্রভুর অাবির্ভূত হয়েছিলেন ৷ ব্রাহ্মন্যবাদের এই সর্বনাশা জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে চৈতন্য মহাপ্রভু বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন ৷ প্রচার করলেন তাঁর উদার বৈষ্ণব মতবাদের ৷ এখানে ব্রাহ্মণ-শূদ্র-মেথর-মুচী বা হিন্দু-মুসলমান কোন জাত বিচার ছিল না ৷ তিনি স্বয়ং উচ্চ ব্রাহ্মণ হয়েও স্বর্ণকার,মালাকার, শঙ্খকার,গোয়ালা প্রভৃতি শূদ্র ও পেশা ভিত্তিক জাতিসমূহের লোকদের সঙ্গে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক করলেন, তাদের কাছে টেনে নিলেন, বুকে জড়িয়ে ধরলেন ৷ তাইতো যবন হরিদাসও তাঁর ভক্ত হত পেরেছিলেন,তাঁকেও তিনি কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ৷ চৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে সবাই ছিলেন সমান, সবাই মানুষ ৷ তাইতো তিনি বললেন;—


"চণ্ডালোপী দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণ ৷ হরিভক্তি বিহীনশ্চ বিপ্রহপি শপচাধম্ ॥" অর্থাৎ—

একজন

চণ্ডালও দ্বিজ থেকে শ্রেষ্ঠ যদি তার মধ্যে হরিভক্তি থাকে, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম থাকে ৷ অার কেউ যদি বিপ্র হয়ে জন্ম নিয়েও হরিভক্তি বিহীন হয় তাহলে সে অধম ৷


অাবার তিনি রণকণ্ঠে বললন;—


"কিবা বিপ্র কিবা নামী শূদ্র কেন নয় ? যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সেই গুরু হয় ॥"

#সে যুগের সাপেক্ষে

বিচার করলে, এই বানী কত বড় বৈপ্লবিক তা সহজেই বোঝা যায় ৷


#চৈতন্য মহাপ্রভুর লেখা বৈষ্ণব ধর্মের ওপর কোন বই পাওয়া যায় না ৷ বৈষ্ণব ধর্মের অাদর্শ কি, লক্ষ্য কি ? বৈষ্ণবদের অাচরণ কেমন হবে,বৈষ্ণব ভক্তির তাত্ত্বিক রূপটাই বা কী ? এসব ব্যাপারে মহাপ্রভুর লেখা প্রামান্য কোন তথ্য বা বই পাওয়া যায় না ৷


বৈষ্ণব ভক্তির তাত্ত্বিক রূপ বৃন্দাবনে পরিস্ফুট হয়েছিল ৷ যাঁদের নিরন্তর চেষ্টার ফলে "গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম" একটা বিশিষ্ট ধর্মীয় মতবাদরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁরা বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামীরূপে অাজও বিখ্যাত ৷ এঁরা হলেন সনাতন গোস্বামী, তাঁর ভাই রূপ গোস্বামী, তাঁদের ভাতুষ্পুত্র জীব গোস্বামী, গোপালভট্র গোস্বামী, রঘুনাথভট্র গোস্বামী এবং রঘুনাথ দাস গোস্বামী ৷


#বৃন্দাবনের গোস্বামীদের রচিত বৈষ্ণব ধর্ম গ্রন্থাবলী বাংলায় নিয়ে অাসেন শ্রীনিবাস অাচার্য, নরোত্তম দত্ত ও শ্যামানন্দ নামে তিনজন প্রভাবশালী বৈষ্ণব ৷ এঁরা এই বৈষ্ণব গ্রন্থগুলি প্রচারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বৈষ্ণবদের নিয়ে "মহোৎসব" অনুষ্ঠানের অায়োজন করতে থাকেন ৷


#বৈষ্ণবদের সবচেয়ে বড় মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল খেতুরিতে ৷ এই খেতুরি মহোৎসবেই বৃন্দাবনে রচিত শাস্ত্রগুলি বাংলার "বৈষ্ণব শাস্ত্র" রূপে স্বীকার করে নেওয়া হয়, অার বৈষ্ণবদের অাচার-অাচরণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বধিমালা নির্দিষ্ট করে গৃহীত হয় ৷ ঐতিহ্য অনুসারে খেতুরীতেই গোস্বামীদের দ্বারা রচিত শাস্ত্র সর্ব বৈষ্ণব গ্রাহ্য হয়েছিল ৷ রাধাকৃষ্ণের যুগল মন্ত্রে চৈতন্যদেবের মূর্তিপূজার শুরু হয় ৷


বাংলার বিভিন্ন জাতির লোকেরা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন, বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পর তাদের বলা হয় "জাত বৈষ্ণব"৷ এই জাত বৈষ্ণব ঐতিহ্য থেকে এটাই বলা যায় যে, চৈতন্যেদেবের কালে অদ্বৈতপ্রভু, নিত্যানন্দপ্রভু, বৈষ্ণব জগদীশ পণ্ডিত,বক্রেশ্বর,গদাধর পণ্ডিত, মানুষের জাতি পরিচয়কে প্রাধান্য দেন নাই ৷

"(তথ্য সংগ্রহ বিভিন্ন সূত্র)"

"জয় মহাপ্রভু !"

 
 
 
Be Inspired
International Mula Gaudiya Sampraday Trust 

Write Us

For Any Assistance Or  Query Please Email Or Call To Us

Imgaudiyas@gmail.com

+918439217878

Vrindavan,Uttar Pradesh, India

  • Facebook
  • Facebook
  • YouTube Social  Icon
  • Whatsapp social icon
  • YouTube Social  Icon
  • Twitter Social Icon
  • instagram social icon
  • Facebook Social Icon

Success! Message received.

bottom of page