UA-199656512-1
top of page


পণ্ডিত শ্রীরঘুনাথ দাস শাস্ত্রীজী মহারাজ প্রকাশিত শ্রীনরোত্তম বিলাস গ্রন্থ হতে------------


কলিযুগ পাবনাবতার শ্রীগৌরসুন্দর । তাঁহার প্রেমলীলা সম্বরণের সাথে সাথে দ্বিতীয় প্রকাশরূপে যে তিন শক্তির উদ্ভব হইয়া ছিল ঠাকুর নরোত্তম তাঁহাদিগের মধ্যে একজন । প্রভু নিত্যানন্দের প্রেমশক্তির প্রকাশই ঠাকুর নরোত্তম । শ্রীমন্মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রাকালে গৌড়দেশে আগমন করতঃ কানাইর নাটশালা হইতে প্রত্যাবর্ত্তন পথে পদ্মগর্ভে প্রেমশক্তির রক্ষা করিয়া আসেন । এতদ্বিষয়ে শ্রীপ্রেমবিলাস গ্রন্থের ৮ বিলাসের বর্ণন---


শ্রীপাদ বলেন প্রেম ভাল রাখ প্রভু ।

গ্রাম উজাড় হয় ইহা নাহি দেখি কভু ।।

প্রভু বলে পদ্মাবতী ধর প্রেম লহ ।

নরোত্তম নামে প্রেম তারে তুমি দিহ ।।

নিত্যানন্দ সহ প্রেম রাখিল তোমাস্থানে ।

যত্ন করি ইহা তুমি রাখিবা গোপনে ।।

পদ্মাবতী বলে প্রভু করো নিবেদন ।

কেমনে জানিব কার নাম নরোত্তম ।।

যাহার পরশে তুমি অধিক উছলিবা ।

সেই নরোত্তম প্রেম তাঁরে তুমি দেব ।।

প্রভু কহে এই সব যে কহিলা তুমি ।

এই ঘাটে রাখ প্রেম আজ্ঞাদিল আমি ।।

আনন্দিত পদ্মাবতী রাখিলেন তটে ।

বিরলে রাখিল প্রেম বিরল যে ঘাটে ।।

ree

এই ভাবে প্রভু নিত্যানন্দ পদ্মাগর্ভে সংরক্ষণ করেন । ঠাকুর নরোত্তমের পিতার নাম শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত, মাতা নারায়ণী, জৈষ্ঠ ভ্রাতা রামকান্ত, তৎপুত্র রাধাবল্লভ, জৈষ্ঠতাত পুরুষোত্তম দত্ত তৎপুত্র সন্তোষ দত্ত ।



তথাহি---ভক্তি ১ তরঙ্গে


জ্যেষ্ঠ পুরুষোত্তং কনিষ্ঠ কৃষ্ণানন্দ ।

শ্রীকৃষ্ণানন্দের পুত্র শ্রীল নরোত্তম ।

শ্রীপুরুষোত্তমের তনয় সন্তোষাখ্য ।।



নরোত্তম বিলাসের ১২ বিলাস--


শ্রীমহাশয়ের জৈষ্ঠ ভ্রাতা রামকান্ত ।

তাঁর পুত্র শ্রীরাধাবল্লভ মহাশান্ত ।।


শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুর মহাশয় মাঘী পূর্ণিমায় আবির্ভূত হন । অন্নপ্রাশন কালে গোবিন্দের প্রসাদ ভিন্ন অন্ন গ্রহণ না করায় তদবধি প্রসাদ গ্রহণ করিতে লাগিলেন । কিছুদিন পরে পিতামাতা পুত্রে বিবাহ দিয়া রাজ্যাভিষেকের অভিপ্রায় করিলে সংবাদ শুনিয়া নরোত্তম অত্যন্ত বিচলিত হইলেন । সহসা একদিন প্রভাতে একাদী পদ্মাস্নানে গমন করেন । সে সময় প্রভু নিত্যানন্দ রক্ষিত প্রেম সম্পদ পদ্মাদেবী প্রকট হইয়া তাঁহাকে অর্পণ করেন । সেই প্রেম প্রভাবে নরোত্তমের বর্ণান্তর ঘটিল এবং প্রেম বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া নৃত্যগীতাদি করিতে লাগিলেন । এদিকে পিতামাতা তাঁহার অনুসন্ধানে আসিয়া বর্ণানন্তর ঘটায় সহসা তাঁহাকে চিন্তিতে পারে নাই । শেষে নরোত্তমের বাহ্যজ্ঞান হইয়া পিতামাতাকে প্রণাম করিলে সকলে চিনিতে পারিলেন । কৃষ্ণকান্ত দেহ গৌরবর্ণ হইল এবং বৃন্দাবন যাইবার জন্য উদ্বিগ্ন হইলেন ।




পিতামাতার আদেশ চাহিলে তাহার বিষপানে প্রাণ ত্যাগ করিতে চাহিলেন । তখন বিষয়ী প্রায় রহিলেন । কৃষ্ণদাস নামক জনৈক বৈষ্ণব মুখে গৌরলীলা শেষে শ্রীনিবাসের মহিমা শুনিয়া তাহার সহিত মিলিত হইবার জন্য ব্যকুল হইলেন । সে সময় জয়গীদার তাহাকে লইবার জন্য লোক পাঠাইয়াছেন । সেই সুযোগে মাতার নিকট বিদায় লইয়া রওনা হইলে পথে জায়গীদারের লোকদের বঞ্চনা করিয়া নবদ্বীপ আদি ভ্রমণ করতঃ বৃন্দাবনে রওনা হইলেন । দ্বাদশ বর্ষীয় শিশু পথে চলিতে চলিতে পায়ে ব্রণাদি অবস্থায় বৃক্ষমূলে শায়িত আছেন , দুগ্ধ হস্তে গৌরসুন্দর স্বপ্নে রূপসনাতন দর্শন দিয়া অশেষ করুণা প্রকাশ করেন । তারপর ব্রজে পৌঁছিয়া গোবিন্দ মন্দিরে জীব গোস্বামীর দর্শন প্রাপ্ত হন । তার পর লোকনাথ প্রভুর সমীপে দীক্ষা গ্রহণ ও শ্রীজীব গোস্বামী সমীপে গোস্বামী শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া ঠাকুর মহাশয় উপাধি প্রাপ্ত হন । কতদিনে শ্রীনিবাস আচার্য্য সহ বৃন্দাবন মিলনে হইল । তারপর বৃন্দাবন লীলাস্থলী দর্শনাদি করতঃ কতককাল অবস্থান করেন । শ্রীজীব গোস্বামীর আদেশে স্রীনিবাস আচার্য্য সঙ্গে গোস্বামী গ্রন্থ লইয়া গৌড়দেশে আগমন করেন । বনবিষ্ণুপুরে গোস্বামীগ্রন্থ অপহৃত হইলে শ্রীনিবাস আচার্য্য তাহাকে খেতুরী প্রেরণ করেন । নরোত্তম খেতুরী গিয়া পিতামাতাদির সহিত মিলন করতঃ কতককাল অবস্থান করিয়া নীলাচল গমন করেন । তথায় তৎকালীন প্রকট গৌরাঙ্গ পার্ষদগণের সহিত মিলন করতঃ গৌড়দেশে আসেন । তথায় নবদ্বীপ আদি সমস্ত লীলাস্থলী দর্শন ও গৌর পার্ষদগণের সহিত মিলন করতঃ খেতুরীতে অবস্থান করিতে লাগিলেন । সে সময় বিগ্রহ স্থাপনের অভিলাষে পাঁচমূর্ত্তি প্রিয়াসহ কৃষ্ণমূর্ত্তি নির্ম্মাণ করেন ।



তথাহি--- নরোত্তম বিলাসে ৯ বিলাস


গৌরাঙ্গ বল্লবীকান্ত শ্রীকৃষ্ণব্রজ মোহন ।

রাধারমন হে রাধে রাধাকান্ত নামোহ স্তুতে ।।



গৌরাঙ্গ বিগ্রহ পাছ পাড়া গ্রামবাসী বিপ্রদাসের ধান্য গোলা হইতে স্বপ্নাদীষ্ট হইয়া প্রকট করেন । বিপ্রদাসের ধান্য গোলায় বহুদিন যাবৎ সর্পভয়ে কেহই তাঁহার পার্শ্বে যাইতে সক্ষম হইত না । ঠাকুর নরোত্তম স্বপ্নাদীষ্ট হইয়া তথায় গমন করতঃ প্রিয়াসহ গৌরসুন্দর প্রকট করেন । গৌরাঙ্গ বিগ্রহ প্রকট করিয়া ভাবাবেশে সঙ্কীর্ত্তন কালে নব তালের সৃজন করেন । তাহাই গরানহাটী সুর নামে খ্যাত । গরানহাট পরগণায় এই তালে সৃজন তাই পরানহাটী সুর নামে খ্যাত ।

তথাহি নরোত্তম বিলাসে-৬ষ্ঠ বিলাসে---


অকস্মাৎ হৃদয়েতে হইল উদয় ।

নৃত্যগীত বাদ্য যে সঙ্গীত শাস্ত্রে কয় ।।

সেইক্ষণে মহাশয় হস্তে তালি দিয়া ।

গায় গৌরচন্দ্র গুণ নিজগণ লৈয়া ।।

কি অদ্ভূত গান সৃষ্টি কৈলা মহাশয় ।

দেখিতে সে নৃত্য গন্ধর্বের গর্বক্ষয় ।।




এভাবে নরতালের সৃষ্টি হইল । তারপর ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শ্রীবিগ্রহ স্থাপন উৎসবে বিশাল বৈষ্ণব সমাবেশ ঘটিয়া ছিল । তৎকালীন প্রকট শ্রীজাহ্নবা দেবী সহ সমস্ত গৌরাঙ্গ পার্ষদগণ একত্রিত হইয়াছিল । এতবড় বৈষ্ণব সমাবেশ ও মহোৎসব তৎপূর্বে ও পরে হয় নাই । শ্রীনিবাস আচার্য্য সপার্ষদে উৎসবের সহযোগিতা করিয়াছিলেন । সেই উৎসবে সঙ্কীর্ত্তনে শ্রীগৌরসুন্দর সপার্ষদে প্রকট হইয়া কীর্ত্তন করিয়াছিলেন । সে কালে প্রকটাপ্রকটের এক অভিন্ন স্বরূপ প্রকাশ পাইয়াছিল । রামচন্দ্র কবিরাজ সহ নরোত্তমের এক অবিচ্ছিন্ন প্রেমসূত্র স্থাপিত হইল । তদবধি রামচন্দ্র খেতুরীতে নরোত্তমের সমীপে অবস্থান করিতে লাগিলেন । রামচন্দ্র কবিরাজ সহ প্রেমরসে অবস্থান করিয়া ভক্তিশাস্ত্র প্রচার ও জীবোদ্ধার করিতে লাগিলেন । শ্রীনরোত্ত ঠাকুরের প্রভাবে কত যে দস্যু উদ্ধার প্রাপ্ত হইয়াছে তাঁহার কোন ইয়ত্তা নাই । দস্যু চাঁদরায় আদি উদ্ধার তাঁহার প্রাকাট্য প্রমাণ । নরোত্তমের শূদ্র হইয়া গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্ত্তী আদি ব্রাহ্মণ শিষ্য করায় ব্রাহ্মণ সমাজ ঈর্ষান্বিত হন । সে কারণ খেতুরী গ্রামে দিব্য উপবীত প্রদর্শন ও গাম্ভীল গ্রামে প্রাণত্যাগ এবং চিতার অস্তির মধ্যে ঐশ্বর্য্য প্রকাশাদি লীলা করেন । বৃন্দাবনে গিয়া রামচন্দ্র কবিরাজ অন্তর্দ্ধান করায় প্রিয়বিচ্ছেদ বিরহাক্রান্ত নরোত্তম প্রেমাবেশে পদাবলী সৃজন করেন ।



তথাহি--- পদকল্পতরু ৪/৩৫/১ পদ


শ্রীআচার্য্য শ্রীনিবাস আছিনু তাঁহার দাস

কথা শুনি জুড়াইত প্রাণ ।

তেঁহো মোরে ছাড়ি গেলা রামচন্দ্র না আইলা

দুঃখে জীউ করে আনচান ।।

যে মোর মনের ব্যাথা কাহারে কহিব কথা

এ ছার জীবনে নাহি আশ ।

অন্নজলে বিষখাই মরিয়া নাহিক যাই

ধিক ধিক নরোত্তম দাস ।।


প্রার্থনা ও প্রেমভক্তিচন্দ্রিকার মধ্যে রামচন্দ্র ও নরোত্তমের অভিন্নতা ও শুদ্ধ রাগমার্গীয় সাধকগণের সাধনের পথ নির্দ্দেশ নির্দ্দেশিত রহিয়াছে । ঠাকুর শ্রীনরোত্তমের রচনা বিষয়ে বল্লভ দাসের বর্ণন---


নরে নরোত্তম ধন্য গ্রন্থাকার অগ্রগণ্য

অগণ্য পূণ্যের একাধার ।

সাধনে সাধক শ্রেষ্ঠ দয়াতে অতি গরিষ্ঠ

ইষ্ট প্রতি ভক্তি চমৎকার ।।

চন্দ্রিকা পঞ্চম সার তিনমণি সারাৎসার

গুরুশিষ্য সংবাদ পটল ।

ত্রিভুবনে অনুপাম প্রার্থনা গ্রন্থের নাম

হাট পত্তন মধুর কেবল ।।

রচিলা অসংখ্য পদ হৈয়া ভাবে গদগদ

কবিত্বের সম্পদ সে সব ।

যেবা শুনে যেবা পড়ে যেবা তা গান করে

সেই জানে পদের গৌরব ।।



চন্দ্রিকা পঞ্চম অর্থাৎ প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা,সিদ্ধ প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা,সাধ্যপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকা,সাধন ভক্তিচন্দ্রিকা ও চমৎকার চন্দ্রিকা । তিনমণি অর্থাৎ সূর্য্যমণি,চন্দ্রমণি ও প্রেমভক্তিচিন্তামণি, গুরু শিষ্য সংবাদ ও উপাসনা পটল । এই ভাবে কতকাল অতিবাহিত করিয়া শ্রীপাট খেতুরী হইতে গাম্ভীলায় আগমন করতঃ গঙ্গাস্নান কালে অন্তর্দ্ধান করেন । এতদ্বিষয়ে স্রীনরোত্তম বিলাসের বর্ণন--


বুধরি হইতে শীঘ্র চলিলা গাম্ভীলে ।

গঙ্গাস্নান করিয়া বসিলা গঙ্গা কুলে ।।

আজ্ঞা কৈলা রামকৃষ্ণ গঙ্গা নারায়ণে ।

মোর অঙ্গ মার্জ্জন করহ দুইজন ।।

দোঁহা কিবা মার্জ্জন করিব পরশিতে ।

দুগ্ধ প্রায় মিশাইল গঙ্গার জলেতে ।।

দেখিতে দেখিতে শীঘ্র হইল অন্তর্দ্ধান ।

অত্যন্ত দুর্জ্জেয় ইহা বুঝিবে কি আন ।।

অকস্মাৎ গঙ্গার তরঙ্গ উথলিল ।

দেখিয়া লোকের মহাবিস্ময় হইল ।।

শ্রীমহাশয়ের ঐছে দেখি সঙ্গোপন ।

বরিষে কুসুম স্বর্গে রহি দেবগণ ।।


এই ভাবে প্রভু নিত্যানন্দের প্রকাশ মূর্ত্তি ঠাকুর নরোত্তম আবির্ভূত হইয়া নামে প্রেমে জগতে ধন্য করতঃ অন্তর্দ্ধান করেন । তাঁহার মহিমা প্রেম বিলাস,ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থাদিতে বিশেষ ভাবে বর্ণিত হইয়াছে ।



*** শ্রীকিশোরী দাস বাবাজী মহারাজ প্রকাশিত শ্রীনরোত্তম বিলাস গ্রন্থ হতে ।




বিশেষ সূচনা


শ্রীঠাকুর মহাশয় বহু গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন । শ্রীঠাকুর মহাশয়ের রচিত বহু গ্রন্থের মধ্যে কেবল শ্রীপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকাই বর্তমানে বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছে, পরন্তু দুঃখের বিষয় এই যে শ্রীঠাকুর মহাশয় কর্তৃক রচিত আরও গ্রন্থ থাকিলেও সেগুলির প্রকাশন হয় নাই আর হইলেও তাঁহার সংরক্ষণের অভাবে তথা কালের প্রভাবে তাঁহা বিলুপ্ত হইয়াছে । শ্রীঠাকুর মহাশয়ের প্রায় ৭০ খানি গ্রন্থের সন্ধান আমারা পাইয়াছি কিন্তু তাঁহার বেশিরভাগই খণ্ডিত । প্রচুর সন্ধান করিয়াও তাঁহার সম্পূর্ণ উদ্ধার আমরা করিতে পারি নাই । আশা করি ক্রমানুসারে ঠাকুর মহাশয়ের গ্রন্থগুলি আমরা প্রকাশনের প্রচেষ্টা করিব ।




নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহ আমরা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি--


১। শ্রীউপাসনাপটল, ২। শ্রীকুঞ্জ বর্ণন, ৩। শ্রীগুরুশিষ্যসংবাদ, ৪। শ্রীচমৎকারচন্দ্রিকা, ৫। শ্রীপ্রেমভক্তিচিন্তামণি,

৬। শ্রীপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, ৭। শ্রীপ্রার্থনা, ৮। শ্রীভক্তিউদ্দীপন, ৯। শ্রীরাগমালা, ১০। শ্রীরসভক্তিচন্দ্রিকা,

১১। শ্রীনিবাসাষ্টকম্, ১২। শ্রীসাধনভক্তিচন্দ্রিকা, ১৩। শ্রীসূর্যমণি । ১৪। শ্রীভক্তিতত্ত্বসার ।


১৩৪৮ ও ১৩৪৯ সালের শ্রীহট্ট সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকায় শ্রীযতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য শ্রীহট্ট সাহিত্য-পরিষদ গ্রন্থাগারে রক্ষিত বাংলা পুথির একটি তালিকা প্রকাশ করেন । উহাঁতে ঠাকুর মহাশয়ের ভণিতায় অতিরিক্ত এই পুথিগুলি আছে---


১। শ্রীগোরচনা, ২। শ্রীরসসাধ্যগ্রন্থ, ৩। শ্রীস্বকীয়া পরকীয়া বিচার, ৪। শ্রীসাধন বিষয়ক এবং ৫। শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস ।


ইহাছাড়া, বিভিন্ন পুথিশালায় অনুসন্ধান করিয়া আমরা আরও কতকগুলি নূতন পুথি পাইয়াছি । এই সমুদয় উল্লেখ সূত্র হইতে শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের নামে যে সব পুথি দেখা গিয়াছে তাঁহাদের সম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া গেল ।



১। প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, ২। সাধ্যপ্রেমচন্দ্রিকা, ৩। সাধনচন্দ্রিকা, ৪। ভক্তিউদ্দীপন, ৫। প্রেমভক্তিচিন্তামণি,

৬। গুরুভক্তিচিন্তামণি, ৭। নামচিন্তামণি, ৮। গুরুশিষ্যসংবাদপটল, ১। উপাসনাতত্ত্বসার, ১০। স্মরণমঙ্গল,

১১। বৈষ্ণবামৃত, ১২। রাগমালা, ১৩। কুঞ্জবন, ১৪। চমৎকারচন্দ্রিকা, ১৫। রসভক্তিচন্দ্রিকা, ১৬। সাধনভক্তি-চন্দ্রিকা, ১৭। উপাসনাপটল, ১৮। ভক্তিলতাবলী, ১৯। শিক্ষাতত্ত্বদীপিকা, ২০। ভজননির্দেশ, ২১। প্রেমমদামৃত,

২২। আশ্রয় তত্ত্ব বা আশ্রয়তত্বসার, ২৩। আত্মজিজ্ঞাসা বা দেহকড়চা, ২৪। চম্পককলিকা বা স্মরণীয় টীকা, ২৫। পদ্মমালা, ২৬। নবরাধাতত্ত্ব, ২৭। দেহতত্ত্ব নিরূপণ, ২৮। প্রেমবিলাস, ২১। বস্তুতত্ত্ব, ৩০। ব্রজনিগূঢ়তত্ত্ব,

৩১। সাধ্যকুমুদিনী, ৩২। সাধনটীকা, ৩৩। ধ্যানচন্দ্রিকা, ৩৪। সহজপটল, ৩৫। সিদ্ধিপটল, ৩৬। রসমঙ্গলচন্দ্রিকা, ৩৭। কাঁকড়া-বিছা গ্রন্থ, ৩৮। রসতত্ত্ব, ৩৯। চতুর্দশপটল বা রাধারসকারিকা বা রসপুরকারিকা, ৪০। সারাৎসার-

কারিকা, ৪১। গুরুদ্রুম কথা, ৪২। ভক্তিসারাৎসার, ৪৩। হাটপত্তন, ৪৪। ব্রজপূরকারিকা, ৪৫। অভিরামপটল,

৪৬। রসবস্তুচন্দ্রিকা, ৪৭। সহজ উপাসনা, ৪৮। সিদ্ধি কড়চা, ৪৯। আশ্রয় নির্ণয়, ৫০। স্বরূপ কল্পতরু, ৫১। রসসার, ৫২। সদ্ভাব চন্দ্রিকা, ৫৩। গোস্বামীতত্ত্ব-নিরূপণ, ৫৪। নরোত্তম দাসের পাঁচালী, ৫৫। শ্রীগোরচনা, ৫৬। রসসাধ্যগ্রন্থ, ৫৭। স্বকীয়-পরকীয়া বিচার, ৫৮। সাধনবিষয়ক, ৫৯। গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস, ৬০। চন্দ্রমণি, ৬১। সূর্য্যমণি,

৬২। সিদ্ধপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকা । ৬৩ । ভক্তিতত্ত্বসার ।


ইহার মধ্যে কিছু গ্রন্থকে শ্রীঠাকুর মহাশয়ের লিখিত না বলিয়া তাঁহার উপর আরোপিত করা হইয়া থাকে । তবে আমরা বাদ বিবাদে যাইতে চাহি না । যাঁহা হউক শ্রীঠাকুর মহাশয়ের গ্রন্থসমূহকে আমরা পুনরায় প্রকাশন করিব বলিয়া সংকল্প করিয়াছি । শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের গ্রন্থ সমূহ প্রকাশনে আপনাদিগের সকলের সহযোগিতা কামনা করিতেছি ।


বিনীত নিবেদক

গুরুবৈষ্ণব চরণাভিলাষী দাসানুদাস রঘুনাথ দাস


 
 
 

ree



♣÷<{শ্রীজীব গোস্বামী}>÷♣ গৌরীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সংবিধানের রচয়িতা হলেন ছয় গোঁসাই। শ্রীরুপ ও সনাতনের ভাইপো শ্রীজীব হলেন অন্যতম পণ্ডিত শুধু তাই নয় বৃন্দাবন লীলায় সখীমঞ্জরির অন্যতম মঞ্জরি হলেন শ্রীজীব গোস্বামী। ১৪৫৫ শকে তিনি জন্মগ্রহন করেন।মাত্র ২০ বৎসর গৃহস্থাশ্রমে ছিলেন।তাঁরপর বৃন্দাবনে গিয়ে শ্রীরুপ গোস্বামীর কাছে মন্ত্রদিক্ষা নিয়ে বাকি জীবন সেখানেই অতিবাহিত করেন। শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীরুপ ও সনাতন গোস্বামীপাদ নিজেদের ভাবজগতে বসে বসে দেখছেন পাহারের গায়ে গরুর নেমে আসার চিহ্ন কিন্তু ওঠার কোনো চিহ্ন নেই। এর কারণ তারা কোনো ভাবেই খুঁজে পেলেন না। মনে মনে ভাবলেন, আজ যদি শ্রীজীব থাকত তাহলে নিশ্চয় এর কারণ বলে দিত।কিন্তু শ্রীজীব কোথায়? সেই যে অভিমান করে চলে গেল আর তো ফিরল না।তার চলে যাওয়ার কারণ কি? অাসামের এগার সিন্ধু নামে এক গ্রামে রুপচন্দ্র কবিরাজ নামে এক পণ্ডিতের জন্ম হয়।বাল্যকালে অত্যন্ত দুরন্ত ও বিদ্যাভ্যাসে অনিহা দেখায় তার পিতা একদিন খাবার পাত্রে খাবারের পরিবর্তে ছায় দিয়ে দিয়েদিলেন। পিতার এই ব্যবহারে অপমানিত ও দুঃখিত হয়ে রুপচন্দ্র গৃহত্যাগী হলেন। রুপচন্দ্র আসামের সমস্ত বড় বড় পণ্ডিতদের কাছে শাস্ত্রশিক্ষা করলেন। উচ্চতর শিক্ষালাভের আশায় চলে এলেন তৎকালীন 'গঙ্গোত্রী নবদ্বীপে। এখানে জন্ম নিয়েছিলেন রাম তর্কবাগীশ, মহাপ্রভুুর শ্যালক জগদীশ তর্কালঙ্কার এবং তার গুরু ভবানন্দ সিধ্যান্ত বাগীশেরর মতো মহা মহা পণ্ডিতেরা।নবদ্বীপে এসে পাণ্ডিত্য অর্জন করে অহংকার ও দিগ্বিজয়ের নেশা তাকে পেয়ে বসল। ষড় গোস্বামীর পাণ্ডিত্যের কথা তিনি শুনেছিলেন।শ্রীরুপচন্দ্র চলে এলেন বৃন্দাবনে।প্রথমে শ্রীরুপ ও সনাতনকে শাস্ত্র তর্কে আহ্বান জানালেন। শ্রীরুপ ও সনাতন কোনোরকম বিচার না করেই কড়জোরে হার মেনে নিলেন। এমন সময় শ্রীজীব যমুনা স্নানে গিয়েছিলেন। পথমধ্যে শ্রীরুপচন্দ্র কবিরাজের সঙ্গে দেখা।শ্রীজীবকে তিনি তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানালেন।তার মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে মনে মনে ভাবলেন এ কোন পণ্ডিত যে আমার গুরুকে তর্কে হারায়। যুবক বয়সের তেজ তাই শ্রীজীব তৎক্ষণাৎ শ্রীরুপচন্দ্র কবিরাজের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নেমে গেলেন এবং শ্রীরুপচন্দ্রকে পরাস্ত করলেন।শ্রীজীবের ফিরতে বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন শ্রীরুপ।কারণ শুনে শ্রীরুপ তীব্র ভাবে ভৎর্সনা ও তীরস্কার করলেন।ছিঃ ছিঃ শ্রীজীব তুমি একি করলে?তুমি শাস্ত্র অহংকারীর,দাম্ভিক,ভক্তিহীনের সঙ্গে তর্ক করলে? দুর হয়ে যাও তুমি,আমি তোমার মুখ দর্শন করতে চাই না ........ " মুখ দর্শন করিবনা তোর, বৃথা তোমা পালিলাম রাজসভা তব সুযোগ্য ঠাঁই, নহে এই ব্রজধাম"।..... শ্রীগুরুর রোষানলে পতিত হয়ে গুরুত্যাগি শ্রীজীব মনের দুঃখে বৃন্দাবনের বনে বনে ঘুরতে থাকলেন।যে মুখ আমার গুরু দেখবেনা সেই মুখ আমি আর কাউকে দেখাবো না । দুঃখে অভিমানে একসময় যমুনা তটে কুমিরের গুহার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে থাকলেন। মাটি খেয়ে খেয়ে পেটে পিলা হয়ে গেল। এই সময় তিনি রচনা করেছিলেন বিখ্যাত গ্রন্থ "শ্রীশ্রী গোপাল চম্পু "। এদিকে শ্রীজীবকে খুঁজতে খুজতে সনাতন গোস্বামী দেখলেন যমুনার তীরে একটি দেহ ভাঁসছে। কিন্তু তার শির কোথায়? করুণার সিন্ধু বৈষ্ণব, তাই মৃতদেহ মনে করে তার দেহটিকে কোলে তুলতে গিয়ে দেখলেন, এ তো শ্রীজীব।তাকে নিয়ে এসে সুস্থ করলেন। পরে গুরু শিষ্যের পুনরায় মিলন করিয়ে দিলেন।আনুমানিক ১৪৮০ শকে তাঁর অন্তর্ধান হয়। ÷<{জয় নিতাই ~জয় গৌরসুন্দর}>÷

 
 
 

ree

ছয়জন বৈষ্ণব সাধক ও  সংস্কৃত পন্ডিত। সনাতন গোস্বামী, রূপ গোস্বামী, রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ ভট্ট ও জীব গোস্বামী এই ছয়জনকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ একত্রে ষড় গোস্বামী নামে অভিহিত করেন। এঁরা কম-বেশি সকলেই চৈতন্যদেবের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং এঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়ই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে।




সনাতন গোস্বামী (আনু. ১৪৬৫-১৫৫৫) ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রে সুপন্ডিত। তাঁর গার্হস্থ্য জীবনের নাম অমর। গৌড়ের নিকটবর্তী রামকেলি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় কর্ণাট ব্রাহ্মণ। তিনি বাক্লা চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্গত ফতেয়াবাদ, নবহট্ট বা নৈহাটী এবং মালদহ জেলার রামকেলি এই তিন জায়গায় বসবাস করেন বলে জানা যায়। নৈয়ায়িক  বাসুদেব সার্বভৌম ও সহোদর মধুসূদন বিদ্যাবাচস্পতি ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। সনাতন সুলতান হুসেন শাহের রাজদরবারে রাজস্বমন্ত্রী (সাকর মলি­ক) হিসেবে কাজ করতেন; তাই আরবি ও ফারসি ভাষায়ও তিনি সুপন্ডিত ছিলেন বলে মনে করা হয়।

রাজকার্যে নিযুক্ত থাকলেও সনাতনের অন্তরে ছিল বৈরাগ্যভাব। চৈতন্যদেবের বৃন্দাবন গমনকালে (সম্ভবত ১৫১৫ খ্রি) রামকেলিতে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর তিনি চাকরি ত্যাগ করেন এবং অল্পকালের মধ্যে শ্রীচৈতন্যের অনুগামী হন। এ সময় থেকেই তিনি সনাতন নামে পরিচিত হন।

চৈতন্যদেব নীলাচলে যাওয়ার পথে কাশীতে দুমাস অবস্থান করেন। সেখানে তিনি সনাতনকে বিভিন্ন তত্ত্বোপদেশ দেন এবং চারটি কার্যের  আদেশ দেন: ১. ভক্তিগ্রন্থ রচনা, ২. ভক্তি ও সদাচার প্রচার, ৩. লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার এবং ৪. শ্রীবিগ্রহ সেবা প্রকাশ। এরপর থেকে সনাতন বৃন্দাবনে অবস্থান করেন এবং বৈষ্ণবধর্মকে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় তিনি সংস্কৃত ভাষায় নানা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। সেগুলির মধ্যে বৃহৎ-ভাগবতামৃত, বৃহৎ-বৈষ্ণবতোষিণী (শ্রীমদ্ভাগবতের টীকা), লীলাস্তব, হরিভক্তিবিলাস  ও দিগ্দর্শনী  (টীকা) উল্লেখযোগ্য।




রূপ গোস্বামী (আনু. ১৪৭০-১৫৫৯) ছিলেন সনাতনের অনুজ। রামকেলিতেই তাঁর জন্ম। তাঁর পিতৃদত্ত নাম সন্তোষ, কিন্তু চৈতন্যদেব প্রদত্ত ‘রূপ’ নামেই তিনি সর্বজনবিদিত। রূপও সুলতান হুসেন শাহের দরবারে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সুলতানের ‘দবির খাস’ (প্রধান সচিব)।

রূপ গোস্বামী বাল্যকাল থেকেই ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। চৈতন্যদেব যখন বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন তখন রূপ তাঁকে প্রয়াগে দর্শন করেন এবং তাঁর নিকট ভক্তিতত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেন। মহাপ্রভুর নির্দেশে তিনি বৃন্দাবন গিয়ে লুপ্ততীর্থ ও লুপ্ত গোবিন্দবিগ্রহ উদ্ধার করেন এবং কয়েকটি মূল্যবান বৈষ্ণবগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: হংসদূত, উদ্ধবসন্দেশ, বিদগ্ধমাধব, ললিতমাধব, দানকেলিকৌমুদী, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, উজ্জ্বলনীলমণি, নাটকচন্দ্রিকা, বিলাপকুসুমাঞ্জলি, উপদেশামৃত, গোবিন্দবিরুদাবলী, অষ্টাদশলীলা, রাধাকৃষ্ণগণোদ্দেশ ইত্যাদি। ষড় গোস্বামীর মধ্যে রূপ গোস্বামীর কবিত্বশক্তি ও পান্ডিত্য অধিক, কেননা তিনি যেসব প্রামাণ্য বৈষ্ণবগ্রন্থ রচনা করেছেন সেসব শুধু সংখ্যা হিসেবেই নয়, কাব্য ও রসবিচারেও উত্তম বলে বিবেচিত হয়। তিনি এসব গ্রন্থে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনের কৃষ্ণতত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ভক্তিরসের বিশদ আলোচনা এবং মধুরভাবে রাধাকৃষ্ণ-উপাসনা রীতির প্রবর্তন করেন।




রঘুনাথ দাস (আনু. ১৪৯০-১৫৭৭) সপ্তগ্রামের হরিপুর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গৃহ-পুরোহিত বলরাম আচার্যের নিকট শাস্ত্রাধ্যয়ন করেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে বৈরাগ্যের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তিনি হরিদাস ঠাকুরের ব্যক্তিত্ব ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সেবা করেন এবং যবন হরিদাসের কৃপাভাজন হন। এসময় চৈতন্যদেবের নাম শুনে তিনি তাঁর চরণে নিজেকে সমর্পণ করেন এবং একদিন গোপনে গৃহত্যাগ করে নীলাচলে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। চৈতন্যদেব তাঁকে স্বরূপ দামোদরের তত্ত্বাবধানে অর্পণ করেন। এজন্য রঘুনাথকে ‘স্বরূপের রঘু’ বলা হতো।

রঘুনাথ ষোলো বছর নীলাচলে ছিলেন। শ্রীচৈতন্য ও স্বরূপ দামোদরের তিরোধানের পর তিনি বৃন্দাবনে রূপ-সনাতনের আশ্রয় গ্রহণ করেন। রঘুনাথ নীলাচল ও বৃন্দাবনে নিত্য জীবনচর্যায় ও প্রসাদ গ্রহণে কঠোর নিয়ম পালন করতেন। তিনি রাধাকুন্ড ও শ্যামকুন্ড উদ্ধার করেন এবং রাধাকুন্ড সংস্কার করে বাকি জীবন সেখানেই অতিবাহিত করেন। শেষ জীবনে তিনি আহার-নিদ্রা বর্জনপূর্বক রাধাকুন্ডের তীরে বসে সর্বদা রাধাকৃষ্ণ নাম জপ করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন। তাঁর আচরণ ও ভজননিষ্ঠা গোস্বামীদের মধ্যেও অতি বিরল। রঘুনাথ দাস রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো: মুক্তাচরিত, স্তবাবলী, দানচরিত বা শ্রীদানকেলিচিন্তামণি, মনঃশিক্ষা, সুরাবলী, শিক্ষাপটল, শ্রীনামচরিত ইত্যাদি।




গোপাল ভট্ট (আনু. ১৫০০-১৫৮৫)  দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ছিলেন। মুরারি গুপ্তের কড়চা থেকে জানা যায় যে, তাঁর বাল্যকালে চৈতন্যদেব দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে তাঁদের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। তখন চৈতন্যদেবের প্রতি তাঁর ভক্তি দেখে পিতা ত্রিমল­ভট্ট (মতান্তরে বেঙ্কক ভট্ট) পুত্রকে চৈতন্যের চরণে সমর্পণ করেন। চৈতন্যদেব তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং তাঁরই আদেশে পিতামাতার সেবান্তে বৃন্দাবনে গিয়ে তিনি অন্যান্য গোস্বামীর সাক্ষাৎ লাভ করেন। চৈতন্যদেব নীলাচল থেকে তাঁর জন্য নিজ কৌপীন ও একটি কাঠের আসন পাঠান। বৃন্দাবনে ‘কাঠের পিড়া’ নামক সেই আসনটি রাধারমণ মন্দিরে এখনও পূজিত হয়। এই মন্দিরের পেছনেই গোপালের সমাধি রয়েছে।

গোপাল সংস্কৃত ভাষা ও দর্শনে সুপন্ডিত ছিলেন। তিনি কৃষ্ণকর্ণামৃত নাটকের শ্রীকৃষ্ণবল্লভা নামে একটি টীকা রচনা করেন। রূপ-সনাতনের মুখে তত্ত্ববিচার শুনে তিনি সূত্রাকারে ষট্সন্দর্ভ  গ্রন্থের একটি কারিকা লেখেন। তাঁর অপর গ্রন্থ সৎক্রিয়াসারদীপিকায় বিবাহাদি চতুর্দশ সংস্কারের বিবরণ আছে। এতে বিভিন্ন বেশ ও বিধির নির্দেশ আছে।  সংস্কৃত সাহিত্য পরিষৎ গ্রন্থাগারে গোপাল ভট্টের লেখা দানখন্ড নামে একটি  পুথি (নং ৪২৭) আছে। হরিভক্তিবিলাস নামে অপর একটি গ্রন্থও গোপাল ভট্টের লেখা বলে কথিত হয়, যদিও কারও কারও মতে এটি সনাতনের রচনা, গোপাল পরে এর বিষয়বস্ত্তকে বিস্তৃত করেন।






রঘুনাথ ভট্ট (আনু. ১৫০৬-১৫৮০) বৃন্দাবনের লুপ্ত তীর্থ ও বিগ্রহ উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া বর্তমানেও বৈষ্ণব ভক্তগণ যে ৮৪ ক্রোশ বন পরিক্রমা করেন সেগুলি নির্ধারণেও তাঁর অবদান ছিল।

রঘুনাথের পিতার নাম তপন মিশ্র। শ্রীচৈতন্য পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে এসে পদ্মার তীরবর্তী রামপুর গ্রামে তপন মিশ্রের আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং তখন রঘুনাথকে ভক্তিতত্ত্ব শিক্ষা দেন। রঘুনাথ কাশীতে বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি নীলাচলে শ্রীচৈতন্যের লীলা প্রত্যক্ষ করেন। পিতামাতার দেহত্যাগের পর তিনি বৃন্দাবনে যান এবং রূপ-সনাতনের সঙ্গ লাভ করেন। সেখানে তিনি  ভাগবতের শ্রেষ্ঠ পাঠক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।




জীব গোস্বামী (আনু. ১৫১৪-১৬০৯) ছিলেন রূপ-সনাতনের ভ্রাতুষ্পুত্র। রামকেলিতে তাঁর জন্ম। জীবের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন গৌড়ে অতিবাহিত হয়। পরে নিত্যানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি নবদ্বীপ যান এবং তাঁর আদেশে কাশীতে পন্ডিত মধুসূদন বাচস্পতির নিকট নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এখানেই পিতৃব্য রূপ-সনাতনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং রূপ গোস্বামী তাঁকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দেন। তাঁদের সান্নিধ্যে জীব জ্ঞানসাধনায় আরও উৎকর্ষ লাভ করেন। তাঁদের তিরোধানের পর জীব গোস্বামী বৃন্দাবনের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। কৃষ্ণমূর্তির বামে রাধামূর্তি বসিয়ে যুগলরূপের পূজা প্রবর্তনে তিনি উৎসাহী ছিলেন।

জীব বাল্যকাল থেকেই শ্রীচৈতন্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন; দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর সেই অনুরাগ আরও বৃদ্ধি পায়। চৈতন্য তথা বৈষ্ণবধর্ম তাঁকে মোহিত করে। তিনি বৈষ্ণবধর্ম ও তন্ত্র-বিষয়ক নানা গ্রন্থ ও টীকা-ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর রচিত ষট্সন্দর্ভ একটি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। এতে ছয়টি সন্দর্ভ বা অধ্যায় আছে এবং তাতে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।

জীব গোস্বামীর আরও কয়েকটি গ্রন্থ হলো: গোপালচম্পূ, হরিনামামৃতব্যাকরণ, ধাতুসূত্রমালিকা, মাধবমহোৎসব, সংকল্পকল্পদ্রুম ও সারসংগ্রহ। এছাড়াও তিনি উজ্জ্বলনীলমণি, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, গোপালতাপনী ও ভাগবতের টীকা রচনা করেন।





 
 
 
Be Inspired
International Mula Gaudiya Sampraday Trust 

Write Us

For Any Assistance Or  Query Please Email Or Call To Us

Imgaudiyas@gmail.com

+918439217878

Vrindavan,Uttar Pradesh, India

  • Facebook
  • Facebook
  • YouTube Social  Icon
  • Whatsapp social icon
  • YouTube Social  Icon
  • Twitter Social Icon
  • instagram social icon
  • Facebook Social Icon

Success! Message received.

bottom of page