UA-199656512-1
top of page

#মহাপ্রভুর_নাম_প্রেম_বিতরণ_লীলায়_শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু;— "(#পর্ব_নয়_পোষ্টনং_২৮/৩৭)"


#মহাপ্রভুর_নাম_প্রেম_বিতরণ_লীলায়_শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু;—


"(#পর্ব_নয়_পোষ্টনং_২৮/৩৭)"


#শ্রীশ্রীনিত্যানন্দকথামৃত;- বৈষ্ণব মহাজন লিখেছেন যদি গৌর না জন্মাতো তাহলে “রাধার মহিমা প্রেমরস সীমা জগতে জানিত কে!” আবার গৌরভক্তরা মনে করেন মহাপ্রভুকে জানতে বা বুঝতে নিত্যানন্দই ভরসা। তিনি দয়াল-ঠাকুর। গৌরভক্তি প্রেমদাতা। তাঁর কৃপাতেই গৌরসুন্দর ধরা দেবেন। ভক্তরা তাই সবার আগেই ঘোষণা করেন– জয় নিতাই। কিন্তু নিত্যানন্দকে জানা কি এতই সোজা! সত্যি কথা বলতে কি– মহাপ্রভুকে জানা বা বোঝার অন্তত চেষ্টাটুকু করা যায়; কিন্তু পদে পদে যিনি বিপরীত তাঁকে বোঝা কার্যত অসম্ভব! ফলে সহজেই হাল ছেড়ে দিয়ে নিত্যানন্দ বিরোধী হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমনটি হয়েছিল তাঁর সমকালে। তাঁর জীবনকাহিনীর মতো তিনি নিজেই এক মহারহস্যময় চরিত্রের দৃষ্টান্ত। বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দ! বস্তুত,গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত দুটি নাম গৌর-নিতাই। আজও গৌর-নিতাই’র দারু বিগ্রহ বাংলার বহু মন্দিরে ও বাড়িতে নিত্য সেবিত। তবে মহাপ্রভুর নামে প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বলতে যা আমরা বুঝি তা হলো নিত্যানন্দ প্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম। মহাপ্রভুকে তিনিই অখন্ড বঙ্গদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য থেকে শুরু করে প্রান্তিক তৃণমূলস্তরেও বৈষ্ণবধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী নিত্যানন্দ। আবার বঙ্গদেশে তাঁর নেতৃত্বে গুরুবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি অধিকাংশ বৈষ্ণবপদকর্তাকে পদ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁর অনুগামীরাই তাঁর উৎসাহে চৈতন্যজীবনী সাহিত্য রচনা করলেও তিনি নিজে রয়ে গেছেন নেপথ্যে।


বীরভূমির একচক্রা আর নদীয়ার নবদ্বীপ ধন্য হয়েছিল যথাক্রমে শ্ৰীনিত্যানন্দ ও শ্ৰীগৌরচন্দ্ৰকে বক্ষে ধারণ করে। কলিতে জীব উদ্ধার মানসে উভয়ের আবির্ভাব।


এই একচক্র গ্রামে বাস করতেন শ্ৰী নিত্যানন্দের পিতা শ্ৰীল মুকুন্দ বন্দোপাধ্যায়, ইনি হাড়াই পণ্ডিত বা হাড়ো ওঝা নামে খ্যাত ছিলেন। এই হাড়াই পণ্ডিতের বিয়ে হয় নিকটস্থ ময়ূরেশ্বর গ্রামের জমিদার রাজা মুকুট নারায়ণের কন্যা, রূপে গুণে অনুপমা, পদ্মাবতীর সঙ্গে। এঁদেরই প্রথম সন্তান নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দ ছাড়া আরও পুত্র কৃষ্ণানন্দ, সর্বানন্দ, ব্ৰহ্মানন্দ, পুর্ণানন্দ, প্ৰেমানন্দ ও বিশুদ্ধানন্দ ছিল হাড়াই পণ্ডিতের। হাড়াই পণ্ডিত যাজকতাও করতেন। ১৪৭৩ খৃষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারী মধ্যাহ্নকাল (১৩৯৫ শকে) মাঘী শুক্লা ত্ৰয়োদশীর দিনে শ্ৰীপাদ হাড়াই পণ্ডিতের ধর্মপত্নী শ্ৰীমতী পদ্মাবতী দেবী এক অপরূপ পুত্ররত্ন প্রসব করেন। ইনিই শ্ৰীনিত্যানন্দ, শ্ৰীকৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম। শ্ৰীমতী পদ্মাবতী গর্ভাবস্থায় নানা অলৌকিক রহস্য দর্শন করতেন। তিনি দেখতেন চতুর্মুখ ও পঞ্চমুখ প্রভৃতি অপূর্বসুন্দর দেবমূর্তিগণ এসে কাকে যেন স্তব করছেন, বলছেন, হে অনন্ত দিব্য প্রকাশ ধন্য তোমার গর্ভবাস। শ্ৰীশ্ৰীনিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থানকে এখনও একচক্র গর্ভবাস বলা হয়। প্রবাদ আছে যে শ্ৰীমতি পদ্মাদেবীর আটমাস গর্ভকালে আচম্বিতে এক যোগীরাজ শ্ৰীহাড়াই পণ্ডিতের গৃহে এসে “এই গর্ভবাস, এই গর্ভবাস,” বলে নৃত্য করেছিলেন। তিনিই ছদ্মবেশী গর্গাচার্য। তার প্রেম বিকার দেখে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কি বলছেন আমরা কিছুই বুঝতে পারছিনা। তিনি বলেছিলেন “শ্ৰীকৃষ্ণের অগ্রজ শ্ৰীবলরাম আসছেন। ‘গর্ভবাস গর্ভবাস, মাঘি শুক্লা ত্ৰয়োদশী দিনে এই একচক্রায় তার আশু প্ৰকাশ।” এ কথা বলতে বলতে ছদ্মবেশী অন্তর্হিত হন। হাড়াই পণ্ডিত নিত্যানন্দকে খুব ভাল বাসতেন ।


হাড়াই পন্ডিত ছিলেন একজন সৎ ব্রাক্ষণ।পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি এবং যজন-যাজনের কাজ মিলিয়ে তাঁর সংসারটি ছিল বেশ স্বচ্ছল।নিত্যানন্দের প্রকৃত নাম ছিল কুবের।গ্রামের পাঠশালায় পিতা তাঁর বাল্যশিক্ষার ব্যবস্থা করেন।ছাত্র হিসবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন।কিন্তু পড়াশোনায় তাঁর একদম মন ছিল না।তাঁর চেয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বেশি।ধর্ম কথা শুনতে তিনি খুব ভালোবাসতেন।পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তিনি খেলাধুলা করতেন বটে, তবে খেলার পরিবর্তে কোনো মন্দিরে গিয়ে বসে থাকতে তাঁর বেশি ভালো লাগত।তাঁর এই ধর্মানুরাগের মূলে ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।কুবের শুধু শ্রীকৃষ্ণের কথাই ভাবতেন।কীভাবে তাঁকে পাওয়া যায়-এই ছিল তাঁর সারাক্ষণের ভাবনা।কোনো সাধু সন্ন্যাসীকে দেখলেই তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন কী করলে শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যাবে।কুবেরের বয়স তখন বারো বছর।তখন এক সন্ন্যাসী এলে তাঁদের গাঁয়ে উঠলেন তাঁদেরই বাড়িতে।তিনি বৃন্দাবনে যাবেন, কুবের শুনেছেন বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেএ। তাই তিনি ভাবলেন, বৃন্দাবন গেলে হয়তো তাঁর প্রাণের ঠাকুর কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে।কুবের সন্ন্যাসীকে তাঁর মনের কথা বললেন।সন্ন্যাসী বললেন, এত অল্প বয়সে সন্ন্যাস নেয়া ঠিক নয়।তাছাড়া সন্ন্যাস নিতে হলে পিতা-মাতার সম্মতি লাগে।


কিন্তু কুবের নাছোড়বান্দা,তিনি বৃন্দাবনে যাবেনই।অগত্যা পিতা-মাতার সম্মতি নিয়ে তিনি সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করলেন।অনেক অরণ্য, পাহাড়-পর্বত, র্তীথস্থান ঘুরে বেড়াতে লাগলেন,বছরের পর বছর কেটে গেল,হঠাৎ একদিন কুবের সন্ন্যাসীকে হারিয়ে ফেলেন।তারপর তিনি একাই বিভিন্ন র্তীর্থ ঘুরতে লাগলেন।এভাবে একদিন উপস্থিত হলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বৃন্দাবনে।এখানে এসে কৃষ্ণদর্শনের জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল।তিনি পাগলের ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একদিন তাঁর সাক্ষাৎ হয় পরম সন্ন্যাসী শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর সঙ্গে।তাঁর কাছে তিনি কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন।গুরু সঙ্গে কিছুদিন বৃন্দাবনে থেকে কুবের আবার বেরিয়ে পড়লেন র্তীথ পযটনে।

বৃন্দাবন দাস লিখেছেন,


"মাধবেন্দ্র পুরী কথা অকথ্য কথন,

মেঘ দরশন মাত্র হন অচেতন।।"


কুবের একা একা বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়ান।এ সময় তিনি রামেশ্বর, নীলাচল, গঙ্গাসাগর প্রভৃতি তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন।কিন্তু কৃষ্ণবিরহের ব্যাকুলতা তাঁর ক্রমেই বাড়তে থাকে।তাঁর একটাই চিন্তা-কৃষ্ণদর্শন কীভাবে হবে।তাই তিনি আবার বৃন্দাবনে ফিরে গেলেন।কুবের সর্বদা কৃষ্ণচিন্তায় বিভোর থাকেন।কীভাবে কখন কৃষ্ণদর্শন হবে-এই তাঁর একমাত্র ভাবনা।এই ভাবনায় তাঁর দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল,হঠাৎ একদিন তিনি কৃষ্ণকে স্বপ্নে দেখেন।প্রভু তাঁকে বলেছেন, তুমি গৌড় দেশে নবদ্বীপে যাও,সেখানে নিমাই পন্ডিত প্রেমভক্তি প্রচার করেছেন,তাঁর সঙ্গে যোগ দাও।উল্লেখ্য যে, এই নিমাই পন্ডিতই শ্রীগৌড়াঙ্গ বা শ্রীচৈতন্য নামে পরিচিত হয় পরবর্তী সময়ে। এভাবে স্বপ্নে কৃষ্ণদর্শন হওয়ার কুবেরের মন অনেকটা শান্ত হয়।স্বপ্নে হলেও তিনি শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভ করেছেন।তাই তাঁর আদেশে তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে নবদ্বীপে আসেন, যেখানে নন্দন আচার্যের গৃহে নিমাইয়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।দুজন দুজনকে চিনতে পারেন, বুঝতে পারেন,যেনো তাঁরা দুয়ে মিলে যেন এক।জীবোদ্ধারের জন্য যেন দুই দেহে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে।সেদিন থেকে কুবেরের নতুন নাম হলো নিত্যানন্দ।সংক্ষেপে নিতাই।আর গৌড়াঙ্গের সংক্ষিপ্ত নাম গৌর।ভক্তরা সংক্ষেপে বলতেন গৌর-নিতাই। নিত্যানন্দ ও মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মহাপ্রভু ভাগবতের একটি শ্লোক পাঠ করে নিত্যানন্দের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। নিত্যানন্দের হৃদয়ে জাগ্রত হয়েছিল অন্তহীন কৃষ্ণপ্রেম। মূর্ছিত নিত্যানন্দকে মহাপ্রভু কোলে করে প্রেমালিঙ্গন দিয়েছিলেন। শচীমাতাও নিত্যানন্দকে দেখে পুরাতন পুত্রশোক ভুলেছিলেন। তিনি যেন বিশ্বরূপ হয়ে ধরা দিয়েছিলেন শচীমাতার কাছে। নবদ্বীপ পর্বে নিত্যানন্দ যেন ক্রমশ গৌড়ের দ্বিতীয় তনু হয়ে উঠেছিলেন।

বৃন্দাবন দাস লিখেছেন–

"মহাবধূত বেশ প্রকাণ্ড শরীর।

নিরবধি ভক্তিরসে দেখি মহা ধীর।।

অহর্নিশ বদনে বোলয়ে কৃষ্ণনাম।

ত্রিভুবনে অদ্বিতীয় চৈতন্যের ধাম।

নিজানন্দে ক্ষণে ক্ষণে করয়ে হুঙ্কার।

মহামত্ত যেন বলরাম অবতার।।"


গৌর-নিতাই দুজনে নবদ্বীপে কৃষ্ণের প্রেমভক্তি প্রচার করতে লাগলেন,নেচে-গেয়ে তাঁরা হরিনাম এর মহত্ত্ব বুঝাতে লাগলেন সবাই কে।তাঁদের প্রেমধর্মে কোনো জাতিভেদ নেই,উঁচু-নীঁচু নেই। তখন সমাজে শুল্ক ধর্মাচরণ প্রবল হয়ে উঠেছিল।মানবপ্রেম তার নীচে চাপা পড়েছিল।তাই প্রেমভক্তি দিয়ে গৌর-নিতাই সমাজের সবাইকে কাছে টেনে নিলেন,ফলে দলে-দলে লোক তাঁদের অনুসরণ করতে লাগলেন। কিন্তু বৈষ্ণব বিদ্বেষীরা গৌর-নিতাইয়ের এই প্রেমধর্ম প্রচারে বাধা দিতে লাগলেন।কখনো কখনো তাঁদের ওপর আক্রমণ ও চলে।সেই সময় নদীয়ার দুই-ছেলে "জগ্ননাথ" ও "মাধব", 'জগাই','মাধাই' নামে কু-খ্যাত ছিলেন। কর আদায়ের জন্য হেন নীচ কাজ নেই যে তারা করত না। তাদের মতো পতিত-দের উদ্ধার করার জন্য, মহাপ্রভু অনেক চেষ্টা করেন ও অকাতরে প্রেম বিলান, কিন্তু কিছুতেই তারা পাপের পথ ছেড়ে দিতে রাজী নয়।

তখন প্রভু-নিত্যানন্দ, যিনি মহাপ্রভুর অন্যতম শিষ্য ও বন্ধু এর জন্য এগিয়ে এলেন। পথের ধারে মাংস ও মদের পাত্র নিয়ে বসে থাকা দুই-ভাইয়ের সামনে তিনি কীর্তন করতে থাকেন। তাদের দু-জনকেও কৃষ্ণ-নাম করার জন্য বার-বার অনুরোধ করতে থাকেন। বিরক্ত হয়ে 'মেধো' তখন মদের মাটির পাত্র ছুঁড়ে প্রভু নিত্যানন্দ এর মাথা ফাটিয়ে দেন। তখন প্রভু নিত্যানন্দ বলেন, " মেরেছিস কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না !' ও-দিকে নিতাই-প্রভুর আহত হওয়ার খবরে ক্রোধে অধীর মহাপ্রভু ছুটে আসেন তাঁদের সামনে। তিনি এই-দুই-অসুর-কে হত্যার জন্য আকাশের দিকে আঙুল করে তাঁর সুদর্শন-চক্র কে আহ্বান করেন। তাঁর মাথার পিছনে একটি দিব্য-চক্র সৃষ্টি হয়। ও-দিকে নিতাই-প্রভু, নিমাই-মহাপ্রভু-র পা ধরে বারংবার ওদের কৃত-কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। এই ঘটনায় কিছুটা বিরক্ত ও ততোধিক বিস্মিত হন মহাপ্রভু।


নিত্যানন্দের কথা শুনে গৌরাঙ্গ অনেকটা শান্ত হলেন।তিনি এগিয়ে জগাইকে বুকে টেনে নিলেন।তা দেখে মাধাইয়ের মনে অনুশোচনা এল।তিনি এগিয়ে এসে বললেন, প্রভু আমি অপরাধ করেছি।আমায় ক্ষমা করে দাও। গৌরাঙ্গ বললেন, নিতাই যদি তোমায় ক্ষমা করে তাহলে তুমি ক্ষমা পাবে।এরপর মাধাই জোরহাতে এগিয়ে গেলেন নিত্যানন্দের দিকে।নিত্যানন্দ তাকে বুকে টেনে নিলেন।এভাবে গৌড়-নিতাই তাঁদের প্রেমভক্তি দিয়ে জগাই-মাধাইকে উদ্বার করলেন।উপস্থিত লোকজন সবাই ধন্য-ধন্য করতে লাগল।এভাবে গৌড়-নিতা নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম র্কীতন ও প্রেমভক্তি দিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে লাগলেন।মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ কমতে লাগল।


মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণে অভিভাবকের মতো প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করে তাঁকে নীলাচলে নিয়ে যাওয়া, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে সাহায্য করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর সদর্থক ভূমিকা লক্ষ করা যায়।নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সঙ্গে নীলাচলে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহাপ্রভু বুঝেছিলেন, তাঁর সঙ্গে নীলাচলে নিত্যানন্দ থাকলে গৌড়কে অনাচার-অত্যাচার থেকে কে রক্ষা করবে ৷ তাছাড়া তিনি অদ্বৈত আচার্যসহ নিত্যানন্দকে গৌড়দেশে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করার আদেশ দিয়েছিলেন।


"নিত্যানন্দে আজ্ঞা দিল যাও গৌড়দেশে।

অনর্গল প্রেমভক্তি করহ প্রকাশে।।"


এর পর থেকেই নিত্যানন্দের জীবনে আবার পরিবর্তন আসে। নিত্যানন্দের সঙ্গী হলেন রামদাস, গদাধর দাস, পরমেশ্বর দাস প্রমুখ বৈষ্ণবপরিকরবৃন্দ। তিনি আগেই সন্ন্যাসীর দণ্ডকমণ্ডলু ভেঙেছিলেন। এবার কৌপীনবস্ত্র ত্যাগ করলেন। দিব্য পট্টবাসে সজ্জিত হলেন। চৈতন্যভাগবতে রয়েছে–


“কাষায় কৌপীন ছাড়ি দিব্য পট্টবাস,

ধরেন চন্দনমালা সদাই বিলাস।"


তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন কৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম হিসাবে। তাঁর প্রধান প্রধান সহচরেরা হয়ে উঠলেন ব্রজের গোপবালক গোপাল। তাঁরাও অদ্ভুত বেশে সজ্জিত হয়ে ভাগবতের যুগকে যেন তাঁদের জীবনে মননে উজ্জীবিত করে তুললেন। বাংলা হয়ে উঠলো বৃন্দাবন। ভাগীরথী হলো যমুনা। বৃন্দাবনদাস লিখেছেন–


"কারো কোন কর্ম নাই সংকীর্তন বিনে।

সভার গোপাল ভাব বাড়ে ক্ষণে ক্ষণে।।

বেত্র বংশী শিঙ্গা ছাঁদডুরি গুঞ্জাহার।

তাড়খাড়ু হাতে পায়ে নূপুর সভার।।"


নিত্যানন্দ এবার বিয়ে করলেন বর্তমান বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনার গৌরীদাস পণ্ডিতের ভ্রাতা সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবাকে। শুরু হলো এক নতুন জীবন। সপ্তগ্রাম অঞ্চলের ধনী বণিকরা তাঁর শিষ্য হলেন। বৈষ্ণবধর্ম এবার পায়ের তলায় মাটি পেল। নিত্যানদ তাঁর পরিকর নিয়ে মহাপ্রভুর নাম ও প্রেমধর্ম প্রচার করতে শুরু করলেন গাঙ্গেয় বাংলায়। বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের মহাপ্লাবন বইতে শুরু করলো।

এদিকে নিত্যানন্দের এই জীবন-যাপন বিশেষকরে সন্ন্যাসী থেকে ধনী গৃহস্থ রূপ ও বিচিত্র আচরণ অনেকের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো। তাঁরা বিরূপ সমালোচনা শুরু করলেন। অনেকেই আবার মহাপ্রভুকে মানলেও নিত্যানন্দের কঠোর সমালোচনা করলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাই, শ্যামদাস, মহাপ্রভুকে মানলেও নিত্যানন্দের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এই কারণে কৃষ্ণদাসের সঙ্গে শ্যামদাসের বনিবনাও হয়নি। বৃন্দাবনদাস নিত্যানন্দ বিরোধীদের একহাত নিয়েছিলেন। আসলে নিত্যানন্দের জীবন বড় রহস্যময়। মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের অন্তত আট দশ-বারো বছর নাম-প্রেম প্রচার করেছিলেন ৷ অথচ তাঁর শেষ জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য জানাই যায় না। মহাপ্রভুর শেষ বারো বছরের দিব্যোন্মাদ পর্বটিও সুচারু ভাবে চিত্রিত করেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ, তাঁর চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে। কিন্তু নিত্যানন্দের ক্ষেত্রে তিনি নীরব। নিত্যানন্দের শেষ জীবনের কোন তথ্যই জানা যায় না।


পঞ্চতত্ত্ব (বৈষ্ণবধর্ম):- গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম মতে, পঞ্চদশ শতকে পৃথিবীতে আবির্ভুত ঈশ্বরের (কৃষ্ণ) পাঁচটি অবতার হলেন পঞ্চতত্ত্ব। এরা হলেন চৈতন্য মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, গদাধর পণ্ডিত ও শ্রীনিবাস ঠাকুর। এঁদের দ্বারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত হরে কৃষ্ণ মন্ত্র ও শ্রীকৃষ্ণের ভক্তির (নিষ্ঠা) কথা ছড়িয়ে পরে।


পাঁচটি বৈশিষ্ট্য :-

চৈতন্য মহাপ্রভু: স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

নিত্যানন্দ :স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিগত বিস্তার এবং বলরামের সংযুক্ত শক্তি।

অদ্বৈত আচার্য :ভগবান বিষ্ণু এবং মহাদেব শিবের যৌথ অবতার।

গদাধর পণ্ডিত: রাধা, ললিতা (গোপিনী) এবং ভগবান কৃষ্ণের অভ্যন্তরীন শক্তির যৌথ অবতার।

শ্রীনিবাস ঠাকুর : ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অকৃত্রিম উপাসক এবং উপাসনার প্রতীক।


পঞ্চতত্বের মন্ত্র:-

গৌড়ীয় ঐতিহ্যে পঞ্চতত্ত্বেরর মন্ত্রে পাঁচজন সদস্যের নাম উল্লেখ আছে। এটি একটি ভক্তিমূলক মন্ত্র যাকে ধ্যানের (জপ) একটি উপায় হিসাবে গাওয়া হয়। প্রায়শই হরে কৃষ্ণ মন্ত্র গাওয়ার সময় এই মন্ত্র গাওয়া হয়ে থাকে। অনুগামীরা বিশ্বাস করে, এটি কলি যুগের একটি করুনাময় মন্ত্র।


“ জয় শ্রী-কৃষ্ণ-চৈতন্য প্রভু-নিত্যানন্দ।

শ্রী-অদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাধি-গৌর-ভক্ত-বৃন্দ।।


বীরচন্দ্রপুর বা একচক্র :- একচক্র নামের উৎপত্তি পান্ডবদের কিংবদন্তীর সাথে জড়িত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যখন কৃষ্ণ তার ভক্ত অর্জুনকে বাঁচাতে যুদ্ধে কোনও পক্ষ না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিলেন, তখন তিনি অর্জুনের সাথে লড়াই করে আসা ভীষ্মদেবকে আঘাত করার জন্য চাকা নিয়ে ছুটে এসেছিলেন। ভীষ্মদেব যখন তাকে অনেক সুন্দর প্রার্থনা দিয়ে সন্তুষ্ট করেছিলেন, তখন কৃষ্ণ তার ক্রোধ হারিয়ে চাকাটিকে একপাশে ফেলে দেন। চাকাটি এই একচক্র গ্রামের জমির উপর পড়ে এবং তাই একচক্র নামটি পায় এই গ্রাম। এক-এর অর্থ একটি, এবং চক্র অর্থ চাকা। মহাভারতে এটিও সেই জায়গা বলে বিশ্বাস করা হয় যেখানে বকাসুর থাকতেন, যাকে পরে ভীমের দ্বারা হত্যা করা হয়। তবে পুরো ভারত জুড়ে বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে যা প্রাচীন একচক্র হিসাবে পরিচিত।


নিত্যানন্দ প্রভুর প্রথম পক্ষের স্ত্রী ছিলেন বসুধা। পুত্র বীরচন্দ্রের নামে ‘একচক্রাধাম’ বর্তমানে বীরচন্দ্রপুর নামে পরিচিত (বীরভূমের তারাপীঠের কাছে)৷


#নিত্যানন্দের_চরিত্রের_অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল শিশুর মতো সারল্য ।কখনো তিনি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে নগ্ন হয়ে যেতেন।কখনো তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন উদ্দাম গঙ্গাবক্ষে।কখনো শিশুর মতো মালিনীর স্তন পান করেছেন।কখনো তিনি মহাপ্রভুর দণ্ড ভেঙে দিয়েছেন।কখনো রাজকীয় বেশ পরিধান করে নামসঙ্কীর্তনে মত্ত হয়েছেন।কখনো সামান্য ত্রুটির জন্য কাউকে গালিগালাজ করেছেন। তবে পাগলের মতো ভালোবেসেছেন মহাপ্রভুকে।এমনি এক বিচিত্র স্বভাবের মহা সাধক ছিলেন নিত্যানন্দ।সাধারণ লোকের পক্ষে তাঁকে বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক।তিনি যেন সমস্ত নিয়মের ঊর্ধে উঠে গিয়েছিলেন। নিত্যানন্দভক্তরা বলেন তিনি বেদ-বিধির অতীত।বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দ। এভাবে তিনি কৃষ্ণনামের সঙ্গে একীভূত করে দেন শ্রীগৌরাঙ্গের নাম।গৌরাঙ্গ-প্রবতিত প্রেমধর্মের এক মহাপ্রচারকরূপে গৌড়দেশে আর্বিভূত হন নিত্যানন্দ।ধমতও্বের কোনো বিচার-বিশ্লেষণ বা তক-বিতক নেই, আচার-অনুষ্ঠানের কোনো বাড়াবাড়ি নেই, শুধু আচন্ডালে প্রেম বিতরণ আর কৃষ্ণনামগান।এভাবে প্রেমভক্তি আর কৃষ্ণনাম প্রচারের মাধ্যমে তিনি অনেক পাপী-তাপীকে উদ্বার করেছেন।সকলকে কৃষ্ণভক্তরূপে ভালোবেসেছেন।তাঁর এই জীবোদ্বারে কথা সারা গৌড়ে ছড়িয়ে পড়ে।দলে-দলে লোকজন তাঁর কাছে ছুটে আসতে থাকে।এর ফলে হিন্দু ধম ও সমাজ জীবনে এক বিরাট আন্দোলনের সৃষ্টি হন।সকলে সমস্ত রকম ভেদাভেদ ভুলে এক সারিতে এসে দাঁড়ায়।র্সাথক হয় শ্রীগৌরাঙ্গের প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণনামের আন্দোলন।নিত্যানন্দও চির অমর হয়ে থাকেন গৌড়বাসীর অন্তরে। গৌরাঙ্গের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে নিত্যানন্দ গৌড়রাজ্য, বিশেষত নবদ্বীপে কৃষ্ণনাম ও প্রেমধর্ম প্রচার করতে লাগলেন।

 
 
 

Comments


Be Inspired
International Mula Gaudiya Sampraday Trust 

Write Us

For Any Assistance Or  Query Please Email Or Call To Us

Imgaudiyas@gmail.com

+918439217878

Vrindavan,Uttar Pradesh, India

  • Facebook
  • Facebook
  • YouTube Social  Icon
  • Whatsapp social icon
  • YouTube Social  Icon
  • Twitter Social Icon
  • instagram social icon
  • Facebook Social Icon

Success! Message received.

bottom of page