শ্রীপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকা
- চাণক্য পণ্ডিত ।। चाणक्य पण्डित
- Aug 30, 2020
- 9 min read
Updated: Sep 17, 2020
শ্রীপ্রেমভক্তিচন্দ্রিকা
কবি নরোত্তম দাস
এই পদটি ১৯৩০ সালে প্রকাশিত, ব্রহ্মচারী নিত্যস্বরূপ সম্পাদিত, “শ্রীহরি সাধক-কণ্ঠহার”, ৭৪-পৃষ্ঠায়
এইরূপে দেওয়া রয়েছে।
অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ॥ ১॥
শ্রীচৈতন্যমনোভীষ্টং স্থাপিতং যেন ভূতলে।
স্বয়ং রূপঃ সদা মহ্যং দদাতি স্বপদান্তিকং॥ ২॥
শ্রীগুরু চরণপদ্ম, কেবল ভকতি সদ্ম,
বন্দ মুই সাবধান সনে।
যাহার প্রসাদে ভাই, এ ভব তরিয়া যাই,
কৃষ্ণপ্রাপ্তি হয় যাহা হনে॥ ৩॥
গুরু মুখপদ্ম বাক্য, হৃদি করি মহা শক্য,
তার না করিহ মনে আশা।
শ্রীগুরুচরণে রতি, এই যে উত্তম গতি,
যে প্রসাদে পূরে সর্ব্ব আশা॥ ৪॥
চক্ষুদান দিল যেই জন্মে জন্মে প্রভু সেই,
দিব্যজ্ঞান হৃদে প্রকাশিত।
প্রেমভক্তি যাহা হৈতে, অবিদ্যা বিনাশ যাতে,
বেদে গায় যাহার চরিত॥ ৫॥
শ্রীগুরু করুণাসিন্ধু, অধম জনের বন্ধু,
লোকনাথ লোকের জীবন |
হাহা ! প্রভু ! কর দয়া, দেহ মোরে পদছায়া,
এবে যশঃ ঘুষুক ত্রিভুবন || ৬ ||
বৈষ্ণব-চরণ-রেণু, ভূষণ করিয়া তনু,
যাহা হৈতে অনুভব হয় |
মার্জ্জন হয় ভজন, সাধুসঙ্গ অনুক্ষণ,
অজ্ঞান অবিদ্যা পরাজয় || ৭ ||
জয় সনাতন রূপ, প্রেমভক্তি রসকূপ,
যুগল উজ্জ্বলময় তনু |
যাহার প্রসাদে লোক, পাশরিল সব শোক,
প্রকট কল্পতরু যনু || ৮ ||
প্রেমভক্তি রীতি যত, নিজ গ্রন্থে বেকত,
লিখিয়াছে দুই মহাশয় |
যাহার শ্রবণ হৈতে, প্রেমানন্দে ভাসে চিতে,
যুগল মধুর রসাশ্রয় || ৯||
যুগল কিশোর প্রেম, লক্ষবান জিনি হেম,
হেন ধন প্রকাশিল যারা |
জয় রূপ! সনাতন ! দেহ মোরে প্রেমধন,
সে রতন মোর গলে হারা || ১০ ||
ভাগবত শাস্ত্র মর্ম্ম, নববিধ ভক্তি ধর্ম্ম,
সদাই করিব সুসেবন |
অন্যদেবাশ্রয় নাই, তোমারে কহিল ভাই,
এই ভক্তি পরম ভজন || ১১ ||
সাধু শাস্ত্র গুরু বাক্য, হৃদয়ে করিয়া ঐক্য,
সতত ভাসিব প্রেমমাঝে |
কর্ম্মী, জ্ঞানী, ভক্তিহীন, ইহাকে করিয়া ভিন,
নরোত্তম এই তত্ত্ব গাজে || ১২ ||
অন্য অভিলাষ ছাড়ি, জ্ঞানকর্ম্ম পরিহরি,
কায়মনে করিব ভজন |
সাধুসঙ্গ কৃষ্ণসেবা, না পূজিব দেবীদেবা,
এই ভক্তি পরম কারণ || ১৩ ||
মহাজনের যেই পথ, তাতে হব অনুরত,
পূর্ব্বাপর করিয়া বিচার |
সাধন-স্মরণ-লীলা, ইহাতে না কর হেলা,
কায়মনে করিয়া সুসার || ১৪ ||
অসৎ সঙ্গতি সদা, ত্যাগ কর অন্য গীতা,
কর্ম্মী, জ্ঞানী, পরিহরি দূরে |
কেবল ভকত সঙ্গ, প্রেমভক্তি রসরঙ্গ,
লীলাকথা ব্রজ রসপুরে || ১৫ ||
যোগী ন্যাসী কর্ম্মীজ্ঞানী, অন্য দেব পূজকধ্যানী
ইহ লোক দূরে পরিহরি |
ধর্ম্ম, কর্ম্ম, দুঃখ, শোক, যেবা থাকে অন্য যোগ
ছাড়ি ভজ গিরিবরধারী || ১৬ ||
তীর্থযাত্রা পরিশ্রম, কেবল মনের ভ্রম,
সর্ব্বসিদ্ধি গোবিন্দচরণ |
সুদৃঢ় বিশ্বাস করি, মদ মাত্সর্য্য পরিহরি,
সদা কর অনন্য ভজন || ১৭ ||
কৃষ্ণভক্ত অঙ্গ হেরি, কৃষ্ণভক্ত সঙ্গ করি,
শ্রদ্ধান্বিত শ্রবণ কীর্ত্তন
অর্চ্চন স্মরণ ধ্যান, নব ভক্তি মহাজ্ঞান,
এই ভক্তি পরম কারণ || ১৮||
হৃষীকে গোবিন্দ সেবা, না পূজিব দেবী দেবা
এই ত অনন্যভক্তি কথা |
আর যত উপলম্ভ বিশেষ সকলি দম্ভ,
দেখিতে লাগয়ে বড় ব্যাথা || ১৯ ||
দেহে বৈসে রিপুগণ, যতেক ইন্দ্রিয়গণ,
কেহ কার বাধ্য নাহি হয় |
শুনিলে না শুনে কান, জানিলে না জানে প্রাণ
দঢ়াইতে না পারে নিশ্চয় || ২০ ||
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাত্সর্য্য, দম্ভসহ,
স্থানে স্থানে নিযুক্ত করিব |
আনন্দ করি হৃদয়, রিপু করি পরাজয়,
অনায়াসে গোবিন্দ ভজিব || ২১ ||
কৃষ্ণ সেবা কামার্পণে, ক্রোধ ভক্ত-দ্বেষী-জনে,
লোভ সাধুসঙ্গে হরিকথা |
মোহ ইষ্ট লাভ বিনে, মদ কৃষ্ণগুণ গানে,
নিযুক্ত করিব যথা তথা || ২২ ||
অন্যথা স্বতন্ত্র কাম, অনর্থাদি যার নাম,
ভক্তিপথে সদা দেয় ভঙ্গ |
কিবা সে করিতে পারে, কাম ক্রোধ সাধকেরে,
যদি হয় হয় সাধুজনার সঙ্গ || ২৩ ||
ক্রোধ বা না করে কিবা, ক্রোধত্যাগ সদা দিবা,
লোভ মোহ এই ত কথন |
ছয় রিপু সদা হীন, করিব মনের ভিন,
কৃষ্ণচন্দ্র করিয়া স্মরণ || ২৪ ||
আপনি পালাবে সব, শুনিয়া গোবিন্দরব,
সিংহ রবে যেন করিগণ |
সকল বিপত্তি যাবে, মহানন্দ সুখ পাবে,
যার হয় একান্ত ভজন || ২৫ ||
না করিহ অসৎ চেষ্টা, লাভ, পূজা, প্রতিষ্ঠা,
সদা চিন্ত গোবিন্দচরণ |
সকল বিপত্তি যায়, মহানন্দ সুখ পায়,
প্রেমভক্তি পরম কারণ || ২৬ ||
অসৎ ক্রিয়া কুটি নাটী, ছাড় অন্য পরিপাটি,
অন্য দেবে না করিহ রতি |
আপনা আপনা স্থানে, পীরিতি সভায় টানে,
ভক্তিপথে পড়য়ে বিগতি || ২৭ ||
আপন ভজন পথ, তাহে হব অনুরত,
ইষ্টদেব-স্থানে লীলাগান |
নৈষ্ঠিক ভজন এই, তোমারে কহিল ভাই,
হনুমান তাহাতে প্রমাণ || ২৮||
শ্রীনাথে জানকীনাথে চাভেদঃ পরমাত্মনি
তথাপি মম সর্ব্বস্বং রামঃ কমললোচনঃ || ২৯ ||
দেব-লোক, পিতৃ-লোক, পায় তারা মহা সুখ,
সাধু সাধু বলে অনুক্ষণ |
যুগল ভঞ্জন যারা, প্রেমানন্দে ভাসে তারা,
তাহার নিছনি ত্রিভুবন ||৩০||
পৃথক আবাস যোগ, দুঃখময় বিষয় ভোগ,
ব্রজবাস গোবিন্দসেবন |
কৃষ্ণকথা কৃষ্ণনাম, সত্য সত্য রসধাম,
ব্রজজনের সঙ্গ অনুক্ষণ || ৩১ ||
সদা সেবা অভিলাষ, মনে করি বিশোয়াস,
সর্ব্বথাই হইয়া নির্ভয়
নরোত্তম দাসে বলে, পড়িনু অসৎ ভোলে,
পরিত্রাণ কর মহাশয় || ৩২ ||
তুমি ত দয়ার সিন্ধু, অধম জনার বন্ধু,
মোহে প্রভু ! কর অবধান |
পড়িনু অসৎ ভোলে, কাম তিমিঙ্গিলে, গিলে
ওহে নাথ ! কর মোরে ত্রাণ || ৩৩ ||
যাবৎ জনম মোর, অপরাধ হৈল ভোর,
নিষ্কপটে না ভজিনু তোমা |
তথাপি তুমি সে গতি, না ছাড়িহ প্রাণপতি,
আমা সম নাহিক অধমা || ৩৪ ||
পতিত-পাবন নাম, ঘোষণা তোমার শ্যাম,
উপেখিলে নাহি মোর গতি |
যদি হই অপরাধী, তথাপিহ তুমি গতি,
সত্য সত্য যেন সতী পতি || ৩৫ ||
তুমি ত পরম দেবা, নাহি মোরে উপেখিবা,
শুন শুন প্রাণের ঈশ্বর |
যদি করু অপরাধ, তথাপিও তুমি নাথ,
সেবা দিয়া কর অনুচর || ৩৬ ||
কামে মোর হতচিত, নাহি মানে নিজ হিত,
মনের না ঘুচে দুর্ব্বাসনা |
মোরে নাথ অঙ্গীকরু, ওহে বাঞ্ছাকল্পতরু,
করুণা দেখুক সর্ব্বজনা || ৩৭ ||
মো সম পতিত নাই, ত্রিভুবনে দেখ চাই,
নরোত্তম-পাবন নাম ধর |
ঘুষুক সংসার নাম, পতিত-পাবন শ্যাম,
নিজদাস কর গিরিধর ! || ৩৮ ||
নরোত্তম বড় দুঃখী, নাথ ! মোরে কর সুখী,
তোমার ভজন সঙ্কীর্ত্তনে |
অন্তরায় নাহি যায়, এই ত পরম ভয়,
নিবেদন করি অনুক্ষণে || ৩৯ ||
আন কথা, আন ব্যথা নাহি যেন যাই তথা,
তোমার চরণ ইতি সাজে |
অবিরত অবিকল, তুয়া গুণ কল কল,
গাই যেন সতের সমাজে || ৪০ ||
অন্যব্রত অন্যদান, নাহি কর বস্তুজ্ঞান,
অন্য সেবা অন্য দেবপূজা
হা ! হা! কৃষ্ণ ! বলি বলি, বেড়াব আনন্দ করি,
মনে আর নাহি যেন দুজা || ৪১ ||
জীবনে মরণে গতি, রাধাকৃষ্ণ প্রাণপতি,
দোঁহার পীরিতিরস সুখে |
যুগল সঙ্গতি যারা, মোর প্রাণ গলে হারা,
এই কথা রহু মোর বুকে || ৪২ ||
যুগল চরণ সেবা, যুগল চরণ ধ্যেবা,
যুগলে মনের পীরিতি |
যুগল কিশোররূপ, কামরতিগণ ভূপ,
মনে রহু ও লীলা কি রীতি || ৪৩ ||
দশনেতে তৃণ ধরি, হা ! হা ! কিশোর কিশোরি !
চরণাজে নিবেদন করে |
ব্রজরাজকুমার ! শ্যাম ! বৃষভানু নন্দিনী নাম,
শ্রীরাধিকা রামামনোহারি ১ || ৪৪ ||
কনক কেতকী রাই, শ্যাম মরকত কাঁই,
দরপ দরপ করু চূর |
নটবর শেখরিণী , নটিনীর শিরোমণি,
দুঁহু গুণে দুঁহু মন বুর্ || ৪৫ ||
শ্রীমুখ সুন্দর বর, হেম নীল কান্তিধর,
ভাবভূষণ করু শোভা |
নীল পীত বাস ধর, গৌরি শ্যাম মনোহর,
অন্তরের ভাবে দুঁহু লোভা || ৪৬ ||
আভরণ মণিময়, প্রতি অঙ্গে অভিনয়,
কহে দীন নরোত্তম দাস |
নিশি দিশি গুণ গাই, পরম আনন্দ পাই,
মনে মোর এই অভিলাষ || ৪৭ ||
রাগের ভজন পথ, কহি এবে অভিমত
লোক-বেদ-সার এই বাণী ||
সখীর অনুগা হইয়া, ব্রজে সিদ্ধদেহ পাইয়া,
সেই ভাবে জুড়াবে পরাণী || ৪৮ ||
রাধিকার সখী যত, তাহা বা কহিব কত,
মুখ্য সখী করিব গণন |
ললিতা বিশাখা তথা, চিত্রা, চম্পকলতা
রঙ্গদেবী সুদেবী কথন || ৪৯ ||
তুঙ্গবিদ্যা ইন্দুরেখা, এই অষ্ট সখী লেখা
এবে কহি নর্ম্মসখীগণ |
রাধিকার সহচরী, প্রিয় প্রেষ্ঠ নাম ধরি,
প্রেম সেবা করে অনুক্ষণ || ৫০ ||
শ্রীরূপমঞ্জরী সার, শ্রীরতিমঞ্জরী আর,
অনঙ্গমঞ্জরী মঞ্জুলালী |
শ্রীরসমঞ্জরী সঙ্গে, কস্তুরিকা আদি রঙ্গে,
প্রেমসেবা করি কুতূহলী || ৫১ ||
এ সব অনুগা হৈয়া, প্রেমসেবা নিব চাইয়া,
ইঙ্গিতে বুঝিব সব কাজ
রূপে গুণে ডগমগি, সদা হব অনুরাগী,
বসতি করিব সখীমাঝ || ৫২||
বৃন্দাবনে দুইজন, চতুর্দ্দিকে সখীগণ,
সময় বুঝিব রসসুখে |
সখীর ইঙ্গিত হবে, চামর ঢুলাব কবে,
তাম্বুল যোগাব চাঁদমুখে || ৫৩ ||
যুগল চরণ সেবি, নিরন্তর এই ভাবি,
অনুরাগী থাকিব সদায় |
সাধনে ভাবিব যাহা, সিদ্ধদেহে পাব তাহা,
রাগপথের এই যে উপায় || ৫৪ ||
সাধনে যে ধন চাই, সিদ্ধদেহে তাহা পাই,
পক্কাপক্ক মাত্র সে বিচার
পাকিলে সে প্রেমভক্তি, অপক্কে সাধন গতি,
ভকতি লক্ষ্মণ তত্ত্বসার || ৫৫ ||
নরোত্তম দাস কয়, এই যেন মোর হয়,
ব্রজপুরে অনুরাগে বাস |
সখীগণ গণনাতে, আমারে লিখিবে তাতে,
তবহি পূরব অভিলাষ || ৫৬ ||
সখীনাং সঙ্গিনীরূপামাত্মানং বাসনাময়ীম্ |
আজ্ঞাসেবাপরাং তত্তদ্রূপালঙ্কারভূষিতাং || ৫৭||
আপনাকে সখীগণের সঙ্গিনী, সখীদিগের আজ্ঞায়
শ্রীরাধাকৃষ্ণের সেবাপরা এবং তাঁহাদের নির্ম্মাল্য
বস্ত্রালঙ্কারে বিভূষিতা গোপকিশেরীরূপে চিন্তা করিবে |
কৃষ্ণং স্মরন্ জনঞ্চাস্য প্রেষ্ঠং নিজসমীহিতং |
তত্তৎকথারতশ্চাসৌ কূর্য্যাদ্বাসৎ ব্রজে সদা || ৫৮||
নিজভাবোচিত লীলাবিলাসী শ্রীকৃষ্ণকে ও তদীয় তাদৃশ
পরিজনকে অর্থাৎ শ্রীবৃন্দাবনেশ্বরী-ললিতা-বিশাখা প্রভৃতিকে
স্মরণ করিতে করিতে তাঁহাদিগের কথায় রত হইয়া সমর্থ
হইলে যথাবস্থিত শরীরে, অসমর্থ হইলে অন্তশ্চিন্তিত শরীরে,
সর্ব্বদা ব্রজে বাস করিবে ||
যুগলচরণ প্রীতি, পরম আনন্দ তথি,
রতি, প্রেমময় পরবন্ধে |
কৃষ্ণনাম রাধানাম, উপায় করোঁ রসাধাম,
চরণে পড়িয়া পরানন্দে || ৫৯ ||
মনের স্মরণ প্রাণ, মধুর মধুর ধাম,
যুগলবিলাস স্মৃতিসার |
বাধ্য সাধন এই, ইহা পর আর নেই,
এই তত্ত্ব সর্ব্ববিধি সার || ৬০ ||
জলদ-সুন্দর-কাঁতি, মধুর মধুর ভাতি,
বৈদগধি অবধি সুবেশ |
পীত বসন-ধর, আভরণ মণিবর,
ময়ূর চন্দ্রিকা করু কেশ || ৬১ ||
মৃগমদ-চন্দন, কুঙ্কুম-বিলেপন,
মোহন-মূরতি-তিরিভঙ্গ |
নবীন কুসুমাবলী, শ্রীঅঙ্গে শোভয়ে ভালি,
মধুলোভে ফিরে মত্তভৃঙ্গ || ৬২ ||
ঈষৎ মধুরস্মিত, বৈদগধি-লীলামৃত,
লুবধল ব্রজবধূবৃন্দ |
চরণকমল পর, মণিময় নূপুর,
নখমণি যেন বালচন্দ্র || ৬৩ ||
নূপুর মরালধ্বনি, কুলবধূ মরালিনী,
শুনিয়া রহিতে নারে ঘরে |
হৃদয়ে বাড়ায় রতি, যেন মিলে পতি সতী,
কুলের ধরম গেল দূরে || ৬৪ ||
গোবিন্দ শরীর সত্য, তাঁহার সেবক নিত্য,
বৃন্দাবন ভূমি তেজোময় |
ত্রিভুবন শোভাসার, হেন স্থান নাহি আর
যাহার স্মরণে প্রেম হয় || ৬৫ ||
শীতল কিরণ-কর, কল্পতরু গুণধর,
তরু লতা ছয় ঋতু সেবা |
গোবিন্দ আনন্দময়, নিকটে বনিতাচর,
মধুর বিহার অতি শোভা || ৬৬ ||
ব্রজপুর-বনিতার চরণ আশ্রয় সার,
কর মন একান্ত করিয়া !
অন্য বোল গণ্ডগোল, না শুনহ উতরোল,
রাখ প্রেম হৃদয় ভরিয়া || ৬৭ ||
পাপ পুণ্যময় দেহ, সকলি অনিত্য এহ,
ধন জন সব মিছা ধন্দ |
মরিলে যাইবে কোথা, ইহাতে না পাও ব্যথা,
তবু নিতি কর কার্য্য মন্দ || ৬৮ ||
রাজার যে রাজ্য পাট, হেন নাটুয়ায় নাট,
দেখিতে দেখিতে কিছু নয় |
হেন মায়া করে যেই, পরম ঈশ্বর সেই,
তাঁরে মন ! সদা কর ভয় || ৬৯ ||
পাপ না করিহ মন ! অধম সে পাপীজন,
তারে মুই দূরে পরিহরি |
পূণ্য যে সুখের ধাম, তার না লইহ নাম
পুণ্য মুক্তি দুই ত্যাগ করি || ৭০ ||
প্রেমভক্তি সুধানিধি, তাহে ডুব নিরবধি,
আর যত ক্ষারনিধিপ্রায় |
নিরন্তর সুখ পাবে, সকল সন্তাপ যাবে,
পরতত্ত্ব কহিনু উপায় || ৭১ ||
অন্যের পরশ যেন, নাহি কদাচিৎ হেন,
ইহাতে হইব সাবধান |
রাধাকৃষ্ণ নাম গান, এই যে পরম ধ্যান,
আর না করিহ পরমাণ || ৭২ ||
কর্ম্মীজ্ঞানী মিছাভক্ত, না হবে তাতে অনুরক্ত,
বিশুদ্ধ ভজন কর মন |
ব্রজজনের যেই রীত, তাহাতে ডুবাও চিত,
এই সে পরম তত্ত্বধন || ৭৩ ||
প্রার্থনা করিব সদা, শুদ্ধভাবে প্রেমকথা,
নাম মন্ত্রে করিয়া অভেদ |
নৈষ্ঠিক করিয়া মন, ভজ রাঙ্গা শ্রীচরণ,
পাপগ্রন্থি হবে পরিচ্ছেদ || ৭৪ ||
রাধাকৃষ্ণ সেবন, একান্ত করিয়া মন,
চরণ কমল বলি যাঁউ |
দোঁহার নাম গুণ শুনি, ভক্তমুখে পুনিপুনি,
পরম আনন্দ সুখ পাঁউ || ৭৫ ||
হেম-গৌরী-তনু-রাই, আঁখি দরশন চাই,
রোদন করিব অভিলাষ
জলধর ঢর ঢর, অঙ্গ অতি মনোহর,
রূপে ভুবন পরকাশ || ৭৬ ||
সখীগণ চারিপাশে, সেবা করিতে অভিলাষে,
যে সেবা পরম সুখ ধরে |
এই মন তনু মোর, এই রসে সদা ভোর,
নরোত্তম সদাই বিহরে || ৭৭ ||
রাধা কৃষ্ণ কর ধ্যান, স্বপ্নেও না বল আন,
প্রেম বিনা আর নাহি চাউ |
যুগলকিশোর-প্রেম, যেন লক্ষবান-হেম,
আরতি পিরিতি রসে ধ্যাউ || ৭৮ ||
জল বিনু যেন মীন, দুঃখ পায় আয়ুহীন,
প্রেম বিনু এই মত ভক্ত |
চাতক জলদগতি, এমতি একান্ত রীতি,
যেন জানে সেই অনুরক্ত || ৭৯ ||
লুবধ ভ্রমর যেন, চকোর চন্দ্রিকা তেন,
পতিব্রতাজন যেন পতি |
অন্যত্র না চলে মন, যেন দরিদ্রের ধন
এই মত প্রেম ভক্তি রীতি || ৮০ ||
বিষয় গরলময়, তাতে মান সুখচয়,
সেই সুখ দুঃখ করি মান |
গোবিন্দ-বিষয়-রস সঙ্গ কর তার দাস,
প্রেম ভক্তি সত্য করি জান || ৮১ ||
মধ্যে মধ্যে আছে দুষ্ট, দৃষ্টি করি হয় রুষ্ট,
গুণ বিগুণ করি করি মানে |
গোবিন্দ বিমুখজন, স্ফূর্ত্তি নহে হেন ধন,
লৌকিক করিয়া সব জানে || ৮২ ||
অজ্ঞান-বিমুগ্ধ যত. নাহি লয় সত্ মত,
অহঙ্কারে না জানে আপনা |
অভিমানী ভক্তিহীন, জগমাঝে সেই দীন,
বৃথা তার অশেষ ভাবনা || ৮৩ ||
আর সব পরিহরি, পরম ঈশ্বর হরি,
সেব মন ! প্রেম করি আশ |
এক ব্রজরাজপুরে, গোবিন্দ রসিকবরে,
করহ সদাই অভিলাষ || ৮৪ ||
নরোত্তমদাস কহে সদা মোর প্রাণ দহে,
হেন ভক্ত সঙ্গ না পাইয়া |
অভাগ্যের নাহি ওর মিছাই হইনু ভোর,
দুঃখ রহু অন্তরে জাগিয়া || ৮৫ ||
বচনের অগোচর, বৃন্দাবন হেন স্থল,
স্বপ্রকাশ প্রেমানন্দঘন |
যাহাতে প্রকট সুখ, নাহি জরা মৃত্যু দুঃখ,
কৃষ্ণলীলারস অনুক্ষণ || ৮৬ ||
রাধাকৃষ্ণ ! দুহুঁ প্রেম, লক্ষবান যেন হেম,
যাহার হিল্লোল রসসিন্ধু |
চকোরনয়ন-প্রেম, কাম রতি করে ধ্যান,
পীরিতি সুখের দুঁহু বন্ধু || ৮৭ ||
রাধিকা প্রেয়সীবরা, বামা দিক্ মনোহরা,
কনক কেশর কান্তি ধরে |
অনুরাগে রক্ত সাড়ী, নীলপট্ট মনোহারী,
মণিময় আভরণ পরে || ৮৮ ||
করিয়ে লোচন পান, রূপ-লীলা দুহুঁ গান,
আনন্দে মগন সহচরী |
বেদবিধি অগোচর, রতন বেদির পর,
সেব নিতি কিশোর কিশোরী || ৮৯ ||
দুর্লভ ভজন হেন্ নাহি ভজ হরি কেন ?
কি লাগি মরহ ভববন্ধে |
ছাড় অন্য ক্রিয়া কর্ম্ম, নাহি দেখ বেদধর্ম্ম,
ভক্তি কর কৃষ্ণপদদ্বন্দ্বে || ৯০ ||
বিষয় বিষম গতি, নাহি ভজ ব্রজপতি,
কৃষ্ণচন্দ্র-চরণ-সুখসার |
স্বর্গ আর অপবর্গ, সংসার নরক ভোগ,
সর্ব্বনাশ জনম বিকার || ৯১ ||
দেহে না করিহ আস্থা, মরিলে যে যম শান্তা,
দুঃখের সমুদ্র কর্ম্মগতি |
দেখিয়া শুনিয়া ভজ, সাধু শাস্ত্র মত যজ,
যুগল চরণে কর রতি || ৯২ ||
জ্ঞান-কাণ্ড কর্ম্ম-কাণ্ড, কেবলি বিষের ভাণ্ড,
অমৃত বলিয়া যেবা খায় |
নানা যোনি সদা ফিরে, কদর্য্য ভক্ষণ করে,
তার জন্ম অধঃপাতে যায় || ৯৩ ||
রাধাকৃষ্ণে নাহি রতি, অন্য দেবে বলে পতি,
প্রেমভক্তি-রীতি নাহি জানে |
নাহি ভক্তির সন্ধান, ভরমে করয়ে ধ্যান
বৃথা তার এ ছার জীবনে || ৯৪ ||
জ্ঞান কর্ম্ম করে লোক, নাহি জানে ভক্তিযোগ,
নানা মতে হইয়া অজ্ঞান |
তার কথা নাহি শুনি, পরমার্থ তত্ত্ব জানি,
প্রেমভক্তি ভক্তগণ প্রাণ || ৯৫ ||
জগৎ ব্যাপক হরি, অজ ভব আজ্ঞাকারী,
মধুর মূরতি লীলাকথা |
এই তত্ত্ব জানে যাই, পরম উত্তম সেই,
তার সঙ্গ করিব সর্ব্বথা || ৯৬ ||
পরম নাগর কৃষ্ণ, তাহে হব অতি তৃষ্ণ,
ভজ তাঁরে ব্রজভাব লৈয়া |
রসিক ভকত সঙ্গে, রহিব পীরিতি-র রঙ্গে,
ব্রজপুরে বসতি করিয়া || ৯৭ ||
শ্রীগুরু ভকত জন, তাহার চরণে মন,
আরোপিয়া কথা অনুসারে |
সখীর সর্ব্বথা মত হইয়া তাহার য থ,
সদাই বিহরে ব্রজপুরে || ৯৮ ||
লীলারস সদা গান, যুগলকিশোর প্রাণ,
প্রার্থনা করিব অভিলাষ |
জীবনে মরণে এই, আর কিছু নাই চাই,
কহে দীন নরোত্তম দাস || ৯৯ ||
আন কথা না বলিব, আন কথা না শুনিব,
সকলি করিব পরমার্থ |
প্রার্থনা করিব সদা, লালসা অভীষ্ট কথা,
ইহা বিনা সকলি অনর্থ || ১০০ ||
ঈশ্বরের তত্ত্ব যত, তাহা বা কহিব কত
অনন্ত অপার কেবা জানে |
ব্রজপুরে প্রেম সত্য, এই যে পরম তত্ত্ব,
ভজ ভজ অনুরাগ মনে || ১০১ ||
গোবিন্দ গোকুলচন্দ্র, পরম আনন্দকন্দ
পরিবার-গোপ-গোপী সঙ্গে |
নন্দীশ্বর যার ধাম, গিরিধারী যার নাম,
সখী সঙ্গে ভজ রঙ্গে || ১০২ ||
প্রেমভক্তি-তত্ত্ব এই, তোমারে কহিনু ভাই,
আর দুর্ব্বাসনা পরিহরি |
শ্রীগুরু-প্রসাদে ভাই, এ সব ভজন পাই,
প্রেমভক্তি সখী অনুচরী || ১০৩ ||
সার্থক ভজন পথ, সাধুসঙ্গে অবিরত,
স্মরণ ভজন কৃষ্ণ-কথা |
প্রেমভক্তি হয় যদি তবে হয় মনশুদ্ধি,
তবে যায় হৃদয়ের ব্যথা || ১০৪ ||
বিষয় বিপত্তি জান, সংসার স্বপন মান,
নরতনু ভজনের মূল |
অনুরাগে ভজ সদা, প্রেমভাবে লীলাকথা,
আর যত হৃদয়ের শূল || ১০৫ ||
রাধিকা-চরণ-রেণু, ভূষণ করিয়া তনু,
অনায়াসে পাবে গিরিধারী |
রাধিকাচরণাশ্রয়, যে করে সে মহাশয়,
তারে মুই যাই বলিহারি || ১০৬ ||
জয় জয় রাধানাম, বৃন্দাবন যার ধাম,
কৃষ্ণসুখ বিলাসের নিধি |
হেন রাধা-গুণ-গান, না শুনিল মোর কাণ,
বঞ্চিত করিল মোরে বিধি || ১০৭ ||
তার ভক্তসঙ্গে সদা, রসলীলা প্রেমকথা,
যে করে সে পায় ঘনশ্যাম |
ইহাতে বিমুখ যেই, তার কভু সিদ্ধি নেই,
না শুনিয়ে তার যেন নাম || ১০৮ ||
কৃষ্ণনাম গানে ভাই, রাধিকা-চরণ পাই,
রাধনাম-গানে কৃষ্ণচন্দ্র |
সঙ্ক্ষেপে কহিনু কথা, ঘুচাও মনের ব্যথা,
দুঃখময় অন্য কথা ধন্দ || ১০৯ ||
অহঙ্কার অভিমান, অসৎ সঙ্গ অসৎ জ্ঞান,
ছাড়ি ভজ গুরুপাদপদ্ম |
কর আত্মনিবেদন, দেহ, গেহ,পরিজন,
গুরুবাক্য পরম মহত্ত্ব || ১১০ ||
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব, রতি মতি তারে সেব,
প্রেম কল্পতরুদাতা |
ব্রজরাজনন্দন, রাধিকার প্রাণধন,
অপরূপ এই সব কথা || ১১১ ||
নবদ্বীপে অবতার, রাধা-ভাব অঙ্গীকার,
ভাব-কান্তি অঙ্গের ভূষণ |
তিন বাঞ্ছা অভিলাষী, শচীগর্ব্ভে পরকাশি,
সঙ্গে সব পারিষদগণ || ১১২ ||
গৌরহরি অবতরি, প্রেমের বাদর করি,
সাধিলা মনের নিজ কাজ |
রাধিকার প্রাণপতি, কি ভাবে কান্দয়ে নিতি,
ইহা বুঝে ভকতসমাজ || ১১৩ ||
গুপতে সাধিবে সিদ্ধি, সাধন নবধা ভক্তি,
প্রার্থনা করিব দৈন্যে সদা |
করি হরি সঙ্কীর্ত্তন, সদাই আনন্দ মন,
কৃষ্ণ বিনা আর সব বাধা || ১১৪ ||
সংসার-বাটুয়ারে, কাম-ফাঁসি বান্ধি মোরে,
ফুকার করহ হরিদাস |
করহ ভকত সঙ্গ, প্রেমকথা নানা রঙ্গ,
তবে হয় বিপদ বিনাশ || ১১৫ ||
স্ত্রী পুত্র বান্ধব যত, মরি যায় কত শত,
আপনারে হও সাবধান |
মুই যে বিষয়হত, না ভজিনু হরিপদ,
মোর আর নাহি পরিত্রাণ || ১১৬ ||
রামচন্দ্র কবিরাজ, সেই সঙ্গে মোর কাজ,
তার সঙ্গ বিনা সব শূন্য |
যদি জন্ম হয় পুনঃ, তার সঙ্গ হয় যেন,
তবে নরোত্তম হয় ধন্য || ১১৭ ||
আপন ভজন কথা, না কহিব যথা তথা,
ইহাতে হইব সাবধান |
না করিহ কেহ রোষ, না লইহ কেহ দোষ,
প্রণমহ ভক্তের চরণ || ১১৮ ||
শ্রীগৌরাঙ্গপ্রভু মোরে যে বলান বাণী,
তাহা বিনা ভাল মন্দ কিছুই না জানি |
লোকনাথ প্রভুপদ হৃদয়ে বিলাস,
প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা কহে নরোত্তমদাস || ১১৯ ।।
Comments